আমি এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক হিসাবে একটি অভিযোগের প্রেক্ষিতে সান্তাল মিশন নরওয়েজিয়ান-এর দিনাজপুরের একটি প্রকল্প পরিদর্শন করছিলাম। প্রকল্পটি মেধাবী ছাত্রদের বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করছে। একজন কো-অর্ডিনেটর মাসের বিভিন্ন সময় প্রকল্প এলাকা সরেজমিনে যাচাই-বাছাই করে এই বৃত্তি বিতরণ করেন। ভালো রেজাল্ট এর অধিকারী সাওতাল ছেলে-মেয়েরা এই বৃত্তি পায়।
সরকারী বৃত্তি বা উপবৃত্তির সাথে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনেরও এক্ষেত্রে কোন তফাৎ নাই। সরকার,
ব্যক্তি ও এনজিও সবাই একই কাজ করছে। সরকার মেধাকে উৎসাহিত করার জন্য শিক্ষা বৃত্তি চালু করেছে। গ্রামীণ পশ্চাপদ নারীর শিক্ষা সুবিধা সম্প্রসারিত করার জন্য সরকার উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠণগুলো ভিন্নতর কাজ করতে পারতো। সামাজিক বনায়ন,
সবজি চাষ,
ফুল-
ফলের গাছের পরিচর্যা ইত্যাদি কাজে উৎসাহিত করার জন্য বৃত্তি চালু করা হলে,
ছাত্র-
ছাত্রীরা কাজ শিখে নিজে উপার্জন করার পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়।
খরা মৌসুমে ফলগাছে পানি ও সার দেয়া, গাছের পরজীবী উদ্ভিদ ধ্বংস করা; খালি জায়গায় সবজি চাষ; ফলজ ও বনজ গাছ রোপনকারী ছাত্র/ছাত্রীকে বৃত্তি দিয়ে সামাজিক উন্নয়নকে উৎসাহিত কাজে তেমন আগ্রহ দেখা যায় না। কোন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এটা করলে সমাজ উপকৃত হতো। সান্তাল মিশন তা না করে সরকারের কাজ ২য় বার করছেন, কেন জানি না!
গোদাগাড়ী হাইস্কুলে আমার প্রধান শিক্ষক ছিলেন মোঃ রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ। ইংরেজী সাহিত্য ও আরবীতে ডাবল এম, এ। শিক্ষকতা পেশার জন্য বি, টি করেছেন। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক সরকারের আইন সভার সদস্য এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে রাজনীতির পাশাপাশি শিক্ষকতাও করছেন। তিনি প্রায়ই বলতেন ‘‘Education is not for the poor’’।
শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই আমি সরকারের বৃত্তিভোগ করেছি। বৃত্তির টাকা দিয়ে খরচ চালার পরও হাতে টাকা থাকতো। কাপড়-চোপড় কিনতে বা মাঝে মধ্যে সিনেমা দেখার জন্য টাকার কোন অভাববোধ করতাম না। আমার দারিদ্র আমাকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করতে পারেনি। বরং স্বচ্ছলতার মুখ দেখিয়েছে। সময়ের প্রেক্ষিতে আমার বাম রাজনীতির প্রতি ছিল প্রবল ঝোক। তাই হেডসারকে এক সময় শ্রেণীশত্রু ভাবতাম। ১৯৭০ সালের এর গোড়ার দিকে সামাজিক সমাজবাদী চেতনায় অনুপ্রাণিত হয়ে অনেক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিয়েছি।
মাসে বৃত্তি পেতাম ৮৫ টাকা। ৪০ টাকা হোস্টেল খরচের পর হাতে থাকতো ৪৫ টাকা। ৭ টাকা গজের জাপানি টেট্রন কাপড়ের কয়েকটা সার্ট এবং প্যান্ট কিনতে অসুবিধা হতো না। বড় চঞ্চল সময় ছিল আমাদের ছোটবেলা। বছরের শুরুর দিকে চোস্ত প্যান্ট দিয়ে শুরু হলেও বছরটা শেষ হয়েছে বেলবটম দিয়ে। বয়স আর সময়ের চঞ্চলতায় চোস্ত, বেলবটম প্যান্ট, ফতুয়া, লম্বা হাতি কলার সার্ট গায়ে তুলতে হয়েছে। শিক্ষা বৃত্তির সুবাদে কোন বেগ পেতে হয়নি।
১৯৭৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। হোস্টেল চার্জ এক লাফে বেড়ে দাঁড়াল ২৩০ টাকা। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ২০০ টাকা বৃত্তি পাবো। প্রাপ্তি কবে ঘটবে তাও জানি না। ২০০ টাকা পেলেও তা দিয়ে চলবে না। বাকি টাকা কোথা হতে জোগাড় হবে জানিনা। রিয়াজ উদ্দিন স্যারের কথাগুলো সত্য মনে হতে শুরু হলো। আজ আর তাঁকে শ্রেণীশত্রু মনে হয় না। হেড স্যারের মত বুঝতে শুরু করলাম নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে।
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার আগেই গোদাগাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়ে বি, এস, সি শিক্ষক ফায়েক স্যার চট্টগ্রাম রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকুরী নিয়ে চলে গেলেন। আশেপাশে কোন বিজ্ঞান শিক্ষক পাওয়া গেল না। শাহাজাহান স্যার পাটিগণিতের মত জটিল অংকের সমাধান করার যাদুকর ছিলেন। ত্রিকোনোমিতির কসথিটা, সাইনথিটা, পদার্থবিদ্যার নিউটনের গতিসূত্রের জটিল অংক এবং রসায়নের সংকেত, বিক্রিয়া ইত্যাদির সমাধান দেয়ার সাধ্য তাঁর ছিল না। ফায়েক স্যারের অভাবে স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ বন্ধ হওয়ার দশা। শিক্ষক-ছাত্রদের অনুরোধে এসএসসি পাশ করার আগেই শখের বসে শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম ১৯৭১ সালের দিকে। সামাজিক রসায়নের বিক্রিয়ার সমীকরণে শখকে পরবর্তীতে পেশা হিসাবে বেছে নিতে বাধ্য হলাম। আমি গোদাগাড়ী স্কুলের এস, এস, সি পাশ বিজ্ঞান শিক্ষক। কিন্তু পড়াশুনা বন্ধ করিনি।
১৯৬৭ সালের দিকে আরও একবার একই অবস্থায় পড়েছিলাম। ১৯৬৫ সালে পাকভারত যুদ্ধ শুরু হয়। আমার বোনের বিয়েও দিতে হলো। বিয়ে দিতে গিয়ে অনেক টাকা-খরচ হয়ে গেল। যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসাবে লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি, আর মুদ্রাস্ফীতি। বিয়ের খরচ যোগাতে হিমসিম খাচ্ছিলাম। মাসিক ২০ টাকা বৃত্তি আর জমি থেকে পাওনা ধান দিয়ে চলছিল না। তারপরও পড়াশুনা বন্ধ করতে হয়নি। তারজন্য আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ আমার বাবার কাছে তিনি আমাকে কাজ করতে শিখিয়েছেন। জেলে না থাকলে তিনি কাজে লেগে থাকতেন।
বাড়ীর পাশে বেশ কিছু ফাঁকা জায়গা আছে। বাবা শখের বসেই বাড়ীর চারধারে লেবু বাগান করেন। লেবুপাতা ও ফুলের গন্ধ বেশ মিষ্টি। লেবু গাছের নীচে কোন ঘাস বা আগাছা থাকেনা বিধায় সাপ আসে না। আমাদের বাড়ীটা বেশ পুরাতন একপাশে মাটির দেয়াল, বেশ উঁচু ভিটা, বন্যায় পানি উঠে না। তাই বাড়িটা সাপের জন্য একটা ভালো ঠিকানা। বাবা বাড়ীর একপাশে লাগালেন লেবু গাছ অন্যপাশে রজনীগন্ধা। এই রজনীগন্ধার পাশে বসে ওজু করার সময় সাপের কামড়েই বাবা ১৯৬২ সালে মারা গেলেন। লেবু গাছগুলো অযত্ন আর অবহেলায় পড়েছিল। ১৯৬৫ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। কৃষিকথা নামে একটা বিষয় পড়ানো হতো। তেমন গুরুত্ব ছিলনা। জনাব ফহিম উদ্দীন স্যার স্কুলের হিসাব-নিকাশ করার পাশাপাশি ষষ্ট শ্রেনীতে কৃষিকথা পড়াতেন। গুরুত্বহীন এই কৃষিকথা আমাকে নাড়া দিয়েছিল। বাড়ীতে বেশ কিছু মোরগ-মুরগী ছিল। মুরগীর বিষ্টা ও পানি দিয়ে লেবুগাছগুলো বাঁচানোর চেষ্টা শুরু করলাম। ফলে এক বছরেই গাছগুলোর চেহারা পাল্টে গেল। গাছ ভরে ফুল এলো। ফুলে ফুলে চারিদিক ভরে গেল। বাড়ীর চালে মৌমাছি বাসা বাঁধলো। মৌমাছিগুলো এখানে অনেকদিন ছিল। অনেক মধু ও হুল দুটোই খেয়েছি। একবার চোখের পাতার উপর একটা মৌমাছি হুল ফুটালো। অনেক দিন ভুগতে হয়েছিল চোখ নিয়ে।
শনি-মঙ্গল বার গোদাগাড়ীতে হাট বসে। হাটে লেবু নিয়ে বেচতে যেতাম। পাইকারী বিক্রি করলে ১৬টা লেবু বেচে পাওয়া যেত আট আনা মানে পঞ্চাশ পয়সা। খুচরা বিক্রি করলে দাম বেশী পাওয়া যায়। তাই লেবুগুলো পাইকারী না বেঁচে খুচরা বিক্রি করতাম। বসে বিক্রি করলে দুই আনা খাজনা আর এক আনা তোলা দিতে হতো। তিন আনার জন্য বসে বিক্রি করিনি, হেঁটে হেঁটে লেবু ফেরি করেছি।
এছাড়াও বেশ কয়েকটা আমগাছ ছিল বাড়ীতে। আমগাছে ডালের দিকে তাকিয়ে দেখতাম কোন পরজীবি উদ্ভিদ আছে কি না। স্থানীয়ভাবে পরজীবিগুলোর নাম ‘ধ্যারা’ বলে। ধ্যারা দেখলেই গাছে উঠে ভেঙ্গে পরিস্কার করতাম। প্রচুর আম ধরতো গাছগুলোতে। খেয়েছি, বিক্রিও করেছি অনেক। লেবু আর আমের উপর ভর করে পাক-ভারত যুদ্ধ পরবরর্তী আকাল সামাল দিয়েছিলাম। লেখাপড়া বন্ধ করতে হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী মুদ্রাস্ফীতি সামাল দিতে পারলাম না । হেরে গেলেও পরাজিত হইনি। শিক্ষকতার পাশাপাশি বাইশ মাইল রাস্তা হাফভাড়ায় বাসে পাড়ি দিয়ে কলেজে গেছি। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে। বেশীদিন আমাকে এভাবে কাটাতে হয়নি। দেশ স্বাধীন হয়েছে। শত্রু সম্পত্তি ঘোষিত বাবার অনেক সম্পদ ফিরে পেয়েছি। দারিদ্র আর আমাদের নাগাল পায়নি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের বৃত্তি নিয়ে আমি ১২ই অক্টোবর বুলগেরিয়া পাড়ি দিলাম।
১৯৮২ সালে লেখাপড়া শেষ করে ফিরে আসলাম। কাজ আমার নেশা। বসে থাকতে পারি না। প্রথমে একটা কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দিলাম। তারপর বিসিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করলাম। সারা বছর বাহিরে বাহিরে থাকি। ওভাবে আর গাছগুলোকে দেখার সুযোগ হয়নি।
ডিসেম্বর, ২০০৪ সালে দেশের বাড়ীতে গিয়ে ২দিন থাকতে হলো। মাকে ঢাকায় আনবো। তিনি অসুস্থ। তাঁর চোখের চিকিৎসা করতে হবে। অনেক বছর পর গাছগুলোর দিকে তাকানোর সুযোগ হলো। আম গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি ধ্যারায় ভরে গেছে। আমি গাছের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে মা বললেন, আগের মত আর আম হয়না। নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমের জন্য কোন কাজ কি আমরা করেছি? আমরা কাজ করি না। শুধু নিয়তিকে দোষারোপ করি। নিয়তি প্রতিবাদ করেনা। নিজের অপরাধের জন্য লজ্জায় পড়তে হয় না। জানি গাছে আম আর ধ্যারা একসাথে থাকতে পারে না, যেমন এক বনে বাঘ আর সিংহ থাকে না। আমরাই ধ্যারাগুলোকে বাড়তে দিয়েছি। এখন আম না ধরার জন্য নিয়তিকে দোষ দিচ্ছি।
বাড়ীর পাশে লেবু গাছের ফাঁকা জায়গাটা এখনও আছে। শুধু লেবু গাছগুলো নেই। কিছু আগাছায় ভরে গেছে। কেন জানি একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বসলো আমার বুকে। রিয়াজ উদ্দিন স্যারের উক্তিকে বিদ্রুপ করেছি আমার কাজ দিয়ে। রক্তের তাপকে কাজে লাগিয়ে দারিদ্র্যকে প্রতিহত করেছি।
আমরা সবকটা ভাই অফিস-আদালতে চাকুরী করি। প্রয়োজন পড়েনা লেবু গাছ হতে উদ্বৃত্ব আয়ের। সময়ও নাই পরিচর্যা করার। দেশ বঞ্চিত হয়েছে উৎপাদন হতে। কে পোষাবে এই ঘাটতি? আমি দরিদ্রের নাগালের বাহিরে চলে এসেছি। গোদাগাড়ী কি দরিদ্র মুক্ত হয়েছে? আম গাছগুলোর দিকে তাকান। জবাব পাবেন। আজও শুনি রাস্তার পাশে নেতার জ্বালাময়ী বক্তৃতা। আমি যেমন দিয়েছি। সমাজবাদী চেতনার ছেলে আমি। ছেলেবেলার কথাগুলো মনে হলে তবুও লজ্জা লাগে। মনে হয় কি বোকা ছিলাম। দারিদ্র্যকে জয় করতে না পারলে সত্যই “Education is not for the Poor”। বাক্যটা নিষ্ঠুর বাস্তবতা।