রাজশাহী জেলার গোদাগাড়ীতে ষাট দশকের মধ্যভাগে আমার জন্ম। প্রাথমিক আর মাধ্যমিক স্তর পাশ করেছি গ্রাম থেকে। ধনী পরিবারে জন্ম নিয়েও নানা ঘাত প্রতিঘাতে দরিদ্র আমার জন্ম সঙ্গী। দরিদ্রের সাথে সংগ্রাম করেই আমার বেঁচে থাকা। পাশের বাড়ী হতে মাকে এক ঝিনুক লবন এনে রান্না করতে দেখেছি ছোট বেলায়। পাশের বাড়ীর বউটি এক চমচ তেল নিতে প্রায়ই আমাদের বাড়ীতে আসতো। এতে আমার মায়ের বা পাশের বাড়ীর ভাবীটির অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছিল কিনা, তা আমার জানা নেই। আমার মায়ের নাম রহিমা বেগম, লেখাপড়া তেমন জানতেন না। গৃহবধু হিসাবে আমাদের বাড়ীতে এসে সবকিছুকে আপন করে নিয়েছেন। কোন দিন তাঁকে তাঁর নিজ বাড়ী ছেড়ে বাপের বাড়ী যেতে দেখিনি।
১৯৬২ সালে বাবা মারা গেলেন। মাকে সংসারের হাল ধরতে হলো। আমার মাসিক স্টাইপেন্ট আর সরকার কেড়ে নেয়ার পর সামান্য যে জমি অবশিষ্ট ছিল তার ধান দিয়েই মাকে সংসার চালাতে হতো। টাকার অংকে যার পরিমান ৫০/- টাকার বেশী নয়। বাবা মারা যাওয়ার আগেই তাঁর বাবা-মা অর্থাৎ দাদা-দাদী ইহালোক ত্যাগ করেন। মায়ের দেবর, ভাসুর বা ননদ জাতের কেউ ছিলনা। তিনি নিজেই তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর মত করে সব কিছু করেছেন। ভুল ধরার বা সমালোচনা করার কেউ ছিল না। নারী হিসাবে তাঁর সব অধিকার না থাকলেও বউ এবং মা হিসাবে তাঁর কোন অধিকার কেউ খর্ব করেনি।
১৯৭৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে প্রদত্ত বুলগেরিয়ান সরকারের বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষার জন্য (১৯৭৪) বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়ায় যাই। ভিতোশার পাঁ ছুয়ে বালকান পর্বত মালার দুই পাশ দিয়ে বিছানো বুলগেরিয়ার প্রাকৃতিক পরিবেশ। নয়নাভিরাম শহরের বড় বড় রাস্তাগুলোর নাম ফরাসী ভাষায় বুলেভার্ড। রাস্তাগুলোর দু’পাশ ফুলে ফুলে ভরা। বুলগেরিয়া আমার কাছে প্রাকৃতিক সম্ভার আর যান্ত্রিকতায় ভরা একটি দেশ। বুলগেরিয়ায় বিদেশী ছাত্র হিসাবে মাসিক বৃত্তি পেতাম ৮৩ লেভা, বুলগেরিয়ান মুদ্রার নাম। কেন বেজোড় একটা অদ্ভুত সংখ্যা বৃত্তি হিসাবে নির্ধারিত হলো তার জবাব পাইনি। সমাজতান্ত্রিক বুলগেরিয়ার শাসন ক্ষমতা ছিল কমিউনিষ্ট পার্টির হাতে। সমাজতন্ত্রের বিধি বিধান অনুযায়ী লেভা, রূপান্তর যোগ্য নয়। তবে হিসাবের প্রয়োজনে লেভা কে এক ডলার হিসাবে বিবেচনা করা হতো। যদিও চোরা বাজারে ডলারের মূল্য ছিল ৩ থেকে ৪ লেভা। এ হিসাবে আমরা পেতাম ২৫ ডলারের মত। আশির দশকে বাংলাদেশী টাকায় ডলারের দাম ছিল ১৬ থেকে ২০ টাকা। বুলগেরিয়ায় আমার বৃত্তির পরিমান ছিল ৪০০ থেকে ৫০০ বাংলাদেশী টাকার প্রায় সমান।
শুকুরের মাংসের প্রাধান্য রয়েছে বুলগেরিয়ার খাবারে। আমি তৃণভোজী বিধায় রান্না করে খেতাম প্রতিদিন। মায়ের সংসার ৫০-৬০ টাকায় চললেও ৪০০-৫০০ টাকায় আমার বুলগেরিয়ায় একা চলতে অসুবিধা হতো। লবন কিনতে হয়েছে কেজি হিসাবে, তেল লিটারে। এক কেজি লবন আর এক লিটার তেল খরচ করতে যে সময় লাগতো তাতে অপচয় হতো প্রায় এক তৃতীয়াংশ। সব কিছুই কিনেছি, অপচয়ও করেছি। বুলগেরিয়া সমাজতান্ত্রিক হলেও ইউরোপের একটি দেশ। তাই ভোগ আর অপচয় সেখানেও কম ছিল না। ‘কেয়ারিং আর শেয়ারিং’ এর চেতনা আর ঐতিহ্য সেখানে তেমন চোখ পড়েনি। সকলেই নিজেকে নিয়ে বড় বেশী ব্যস্ত।
চাকুরীর সুবাদে ঢাকায় থাকি। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকের কথা। পাশের ফ্লাটের কর্তা ব্যক্তিটি একটা আধাসরকারী সংস্থায় চাকুরী করেন। পাশাপাশি ফ্ল্যাট বাড়ী হওয়ার সুবাদে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেক কিছু জানতে শুনতে হয়। কাজের মেয়েকে নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে স্বামী প্রবর বললেন:
-‘তোমাদের ভালো না লাগলে তাঁকে বিদায় দাও। বেঘোড়ে কোন আঘাত লাগলে ঝামেলায় পড়তে হবে।’
সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী ধমকের সুরে বললেন,
-‘নিজের স্ত্রীর জন্য দরদ নাই। সারাদিন অফিসে পড়ে থাকো। কাজের মেয়ের জন্য এত দরদ কেন শুনি।’
ভদ্রলোক বুদ্ধিমান। সংসারে অশান্তি ডেকে আনতে চাননি। চুপ করে গেলেন। কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া থেমে থাকেনি। পরদিন সকাল বেলা স্বামী প্রবর অফিস যাওয়ার পর শুরু হয় তান্ডব।
-‘আমার স্বামীর আমার জন্য দরদ নাই, তোর জন্য এত দরদ কেন?’ ভদ্রমহিলা চিৎকার শুরু করে দিলেন।
কাজের মেয়েটি ভয় পেয়ে জবাব দিল- ‘আপনি কি বলছেন খালাম্মা? আমি কি করেছি?’
সঙ্গে সঙ্গে গৃহকত্রীর চিৎকার- ‘কি করেছিস মানে! আমার সব কিছু শেষ করে দিয়ে, আবার মুখে মুখে কথা।’
মুখের কথার সঙ্গে সঙ্গে হাতের লোহার রডটি থেমে ছিল না। একটা চিৎকার, তারপর সবশেষ। কর্তা ব্যক্তিটিকে এ নিয়ে পুলিশ ও সাংবাদিকের ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। বিস্তর টাকাও খরচ হয়েছে।
পুরো ঘটনাটাই পরে মায়ের কাছ থেকে শোনা। আমার অসুস্থতার কারণে তিনি ঢাকায় আমার এখানে ছিলেন। কি প্রয়োজন ছিল এ মৃত্যুর?
‘নারায়নগঞ্জে শ্বাশুড়ী-ননদ মিলে নতুন গৃহ বধুকে হত্যা করেছে।’ পত্রিকার পাতা খুললেই এ ধরনের সংবাদ চোখে পড়ে। শ্বশুর, দেবর, ভাসুর নির্যাতন চালালেও এ ধরনের ঘটনা তুলনা মূলক অনেক কম। কেন? সব কিছুই আমাকে যন্ত্রণা দগ্ধ করে তুলে।
ইউরোপে পুরুষ নারী উভয় উভয়কে নির্যাতন করছে, এটা ইউরোপে সাধারণ ঘটনা। ধনবানদের অনুসংঙ্গ হিসেবে নারী থাকবেই। এশিয়াতেও এ ভোগ আছে। তবে তা নারী নির্যাতন কি না, এটা একটি প্রশ্ন? ভাববার বিষয়ও বটে। তবে বাংলাদেশে বধু নির্যাতিত হয়, কাজের মেয়ে নির্যাতিত হয়। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবো না। এটাকে ঢালাওভাবে নারী নির্যাতন বলা যাবে কি না, পাঠকই ভালো বলতে পারবেন।
ইউরোপ-আমেরিকা লিঙ্গ নির্ভর সমাজ ব্যবস্থা। এশিয়া সম্পর্ক নির্ভর। ইউরোপ-আমেরিকা লিঙ্গ বৈশম্য, আর এশিয়া সম্পর্ক বৈশম্য। নারী নির্যাতন আর কাজের মেয়ে নির্যাতন এবং বউ নির্যাতন এক ও অভিন্ন ঘটনা নয়। আজকের বধু, কালক্রমে সে শ্বাশুড়ী। বউ হিসাবে যা কিছুকে নির্যাতন মনে করতেন, শ্বাশুড়ী হয়ে বলছেন এ শিক্ষার দরকার ছিল। তাই শ্বাশুড়ী হয়ে তিনি এসব তাঁর পুত্রবধুর উপর প্রয়োগ করছেন।এশিয়ার বউ-শ্বাশুড়ী সম্পর্ক শুধু দ্বন্দ্বের নয়, ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর সহযোগিতাও রয়েছে এ সম্পর্কে। তবে দিন দিন তা কমছে। এটাই ভয়ের কারণ।
১৯৯০ এর দশকের মধ্য ভাগে শুক্রাবাদ বাজারের সাথে একটা বাসায় ভাড়া থাকি। বাড়ীওয়ালা একবারে মাসে ২ হাজার টাকা ভাড়া বাড়ালো। একসংগে ২ হাজার টাকা ভাড়া বেশী দেয়া সম্ভব ছিল না। বাসাটা ছেড়ে দিলাম। তবুও শুক্রাবাদ ছাড়তে পারিনি। বাজার থেকে বেশ কিছু ভিতরে শুক্রাবাদ কমিশনারের বস্তির পাশে ২১/১সি এর ৪র্থ তলায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। ছোট ২ রুমের বাসায় ভাড়া থাকি। পাশের বস্তিটায় ঢাকা শহরের আশির দশকে গড়ে উঠা গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাস। ছোট্ট বেলায় গ্রামে দেখা শেয়ারিং-কেয়ারিং এর উপর নির্ভর করে এরা ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা খরচ করে দিব্বি বেঁচে আছে। এরা প্রতি শুক্রবার সিনেমায় যায়, সাবান-শ্যাম্পুও কিনে।
পানি, চুলা, বাজার এমন কি জামা কাপড় পর্যন্ত এখানে ভাগ করে ব্যবহার করে। ‘তুমি আমার বন্ধু হতে পারো, তোমার রোগ জীবানু আমার বন্ধু নয়’- ইউরোপীয় এই শ্লোগন এখানে অকার্যকর। এখানে এদের আলাদা কোন সত্তা নাই। তাঁরা তাঁদের মধ্যে একাকার হয়ে আছে। একটি ‘সেট এলিমেন্ট’ হিসাবে তারা একাকার। আলাদা জীবন আর জীবিকার তাগিদে আলাদা হওয়ার সামর্থ্য তাঁদের নেই।
আমার বউয়ের বিশ্বাস মা অনেক কষ্ট করেছেন। তাঁর কোন কাজ করার প্রয়োজন নাই। ছেলেদের বাড়ীতে তিনি এলে তাঁকে কিছু করতে দেন না। তিনি এভাবে বসেও থাকতে চান না। এ কারণে নিতান্ত ছেলে মেয়ের অসুখ-বিসুখ ছাড়া তিনি তাঁর সংসার ছাড়েন না।
১৯৮৮ সালের ঈদের ছুটিতে নাইট কোচে রাজশাহী যাচ্ছিলাম। নাইটকোচের সঙ্গে ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। আমরা ভাগ্যবান কয়েকজন বেঁচে গেলাম। আমি তাঁদের একজন। কিন্তু চোয়ালের হাড় ভেঙ্গে গেল। রাজশাহী হাসপাতালে অপারেশন করে জোড়া লাগানো হলো। চমৎকার ভাবে জোড়া লেগেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের চিকিৎসা শাস্ত্র এবং চিকিৎসকদের সীমাবদ্ধতা অনেক। হাড়ের ভিতরে ফাঁটা ছিল যা এক্সরেতে ধরা পড়ল না। মজ্জা বাহির হয়ে তৈরী হলো একটা টিউমার, নাম এ্যামিলোব্লাস্টোমা। ১৯৯০ সালে থাইল্যান্ড এর ব্যাংকক এ গিয়ে অপারেশন করে চোয়ালের একতৃতীয়াংশ ফেলে দিয়েছিলাম। ১৯৯৭ সালে টিউমারটির অন্য অংশ বৃদ্ধি পেল। ঢাকাতেই অপারেশন করে বাকি এক-তৃতীয়াংশও কেটে ফেলার সময় মা আমাদের সাথে অনেক দিন ছিলেন।
আমার স্ত্রী সরকারী কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৯৭ সালে জগন্নাথ কলেজে রাষ্ট্র বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। তাঁর অনেক সহকর্মী ও শুভাকাংঙ্খী, মা এবং আমার কুশলাদি জানার জন্য আমাদের বাড়ীতে আসতেন। ছোট বেলা থেকে দেখছি মা আগে আমাদের খাওয়াতেন পরে নিজে খেতেন। কোন ব্যতিক্রম হতে দেখিনি। ঢাকা এসেও তিনি তার ব্যতিক্রম করেননি। এটা আমার বউয়ের ভালো লাগতো না। সহকর্মীদের পরামর্শে আমার বউ সিদ্ধান্ত নিলো, “মাকে আগে খাওয়াতে হবে এবং মাকে কোন কাজ করতে দেয়া যাবে না”।
মায়ের করার মত কোন কাজ নাই। তিনি ঢাকায় থাকতে চান না । আগে তিনি তাঁর ইচ্ছা মত রান্না ঘরে গিয়ে খাবার তৈরী করতেন। এখন তাও করতে দেয়া হয়না। এভাবে বেশ কিছুদিন চললো। তাঁর ক্ষুধা লাগে না। তিনি খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিলেন। ক’দিন পর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাঁকে রাজশাহীতে রেখে আসা হলো। তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। তবে সময় লাগলো অনেক দিন।
তাঁর অসুস্থতার কারণ আজও আমার অজানা। অজানা এক ভয় পেয়ে বসলো, তাঁকে ঢাকায় আসতে বলতে পারি না। অনেক দিন পর মায়ের সঙ্গে কথায় কথায় জানাতে চাইলাম- “মা, আমাদের আগে খেতে তোর আপত্তি কেন?”
মা এর বিরক্তিভরা জবাব-“আগে যে খেতে চায় সে খাক। আমি তোদের খাইয়ে যে আনন্দ পাই তা থেকে আমাকে বঞ্চিত করার অধিকার তোর বউকে কে দিয়েছে?” আমি কোন জবাব দিতে পারিনি।