‘বাঁচতে শেখা’ যশোর এলাকায় স্বনামে খ্যাত একটি বেসরকারী সংস্থা। মিস এ্যাঞ্জেলা গোমেজ সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক। তাঁর কাজের জন্য তিনি মাকসাই পুরষ্কার পেয়েছেন। মহিলারা সূর্য উঠার আগে কাজ শুরু করেন এবং সবাই যখন রাতে ঘুমে ব্যস্ত তখন শেষ হয় তাঁদের কাজ। এ্যাঞ্জেলা গোমেজ মেয়েদের এই নারকীয় অবস্থা হতে মুক্তি দিতে চান। তিনি তাঁর একক প্রচেষ্টায় গড়ে তুলেছেন বিশাল প্রতিষ্ঠান ‘বাচতে শেখা’। তিনি বহু মহিলাকে নরক যন্ত্রণা হতে মুক্তি দিয়েছেন। তাঁর বিশ্বাস, বিশ্রাম স্বর্গীয়, কাজ নারকীয়। এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক হিসেবে চাকুরীর সময় একটা বিশেষ তদন্ত করতে গিয়ে বাঁচতে শেখার গেষ্ট হাউজে থাকতে হলো। তিনি দয়া করে দেখা করতে এসেছেন। আমি কথায় কথায় বললাম “বিশ্রামও নারকীয় হতে পারে”। ‘আমি বিশ্বাস করিনা’ এ্যাঞ্জেলা গোমেজের প্রতিক্রিয়া।
অনেক দিন আগে কোন একটা পত্রিকায় একটা গল্প পড়েছিলাম। পত্রিকা বা লেখকের নাম কোনটাই মনে নেই। শুধু গল্পটা মনে আছে। প্রাসঙ্গিক তাই বলার লোভ সামলাতে পারছি না। লেখককে স্বীকৃতি দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। গল্পটা শুনুন,
একজন সন্ত্রাসী খুন, জখম, লুটতরাজ করেই দিন কাটাচ্ছিল। মদ, গাঁজা, চরস ছিল তাঁর নিত্য সাথী। ধর্ষণ, নারী ভোগ ছাড়া তাঁর একটা দিনও চলতো না। প্রতিদিনের মেনুতে থাকতো সুস্বাদু খাবার আর পানীয়। একদিন গোলাগুলিতে সে মারা গেল। মৃত্যুর পর তাঁর সামনে একজন দেবদূত হাজির হলেন। নূরানী চেহারা। দেবদূত আদরমাখা কন্ঠে বললেন;
- ‘বৎস, তুমি জীবিত অবস্থায় নেশা করতে। নারী সম্ভোগ ছিল তোমার বড় আনন্দের বিষয়।’
- ‘আমি এ জন্য গর্ববোধ করি জনাব’ মৃত সন্ত্রাসীর দাম্ভিক জবাব।
- ‘দেখ, এখানে আছে সব ধরনের নেশা! নারীর কোন অভাব নাই। যত খুশি তুমি ভোগ করতে পারো।’ দেবদূত জানালো।
দেবদূতের কথায় সন্ত্রাসী মহাখুশি। জীবনে মরনে কোন তফাৎ নেই। কিন্তু একটা বিষয় তাঁকে অবাক করলো। ধর্ষণ করলে কোন বাধা আসে না। পুলিশ, আদালত কোন কিছু হয় না।
মৃত্যুর পরও মর্তের মত সব পেয়ে ভালই দিন কাটছিল। কিন্তু অনন্তকাল এক জিনিস কি ভালো লাগে! মৃত সন্ত্রাসী একদিন চ্যাঁচামিচি শুরু করলো। দেবদূত এসে জিজ্ঞাসা করলো- ‘তোমার কি কোন অসুবিধা হচ্ছে বৎস? তুমি কি কিছু চাও?’
- ‘আমি খেলাধুলা করতে চাই।’ মৃত সন্ত্রাসী দাবী করলো।
- ‘তথাস্ত বৎস, তোমার পাশের জিমনেশিয়ানে তুমি যখন খুশি খেলাধুলা করতে পারো।’ দেবদূত জানালো।
এভাবে চললো আরও কিছুদিন। অদ্ভুত ব্যাপার জিতলে কেউ হাততালি, বাহবা দেয় না। হারলেও কোন ভৎর্সনা করা হয় না। কিন্তু এভাবে তো আর ভালো লাগে না। সে চেঁচামেচি করে আবারও দেবদূতকে তাঁর কাছে আসতে বাধ্য করলো।
- ‘কি চাও?’ দেবদূত জিজ্ঞাসা করলেন।
- ‘দেবদূত আমাকে কাজ দিন। আমার কাজ চাই।’ সন্ত্রাসীর আবেদন।
- ‘এখানে কোন কাজ নাই। তোমাকে কোন কাজ দেওয়া সম্ভব নয়।’ দেবদূতের জবাব।
- ‘তাহলে আমি এ স্বর্গেই থাকবো না। আমাকে নরকে পাঠাও।’ মৃত সন্ত্রাসীর অনুরোধ।
- ‘কে বলেছে তুমি স্বর্গে আছো?’ দেবদূতের তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া।
এখানেই গল্পের শেষ। গোমেজকে বুঝাতে চেয়েছিলাম বিশ্রামে স্বর্গীয় সুখ আছে, নরক যন্ত্রণাও কম নয়। কাজে নরক যন্ত্রণা আছে, আছে স্বর্গীয় সুখ। ফুলে মধু, গন্ধ, বিষ, সৌন্ধর্য্য সবকিছুই আছে। মৌমাছি মধু নিবে, অন্যদিকে মাকড়সার দরকার বিষ। আর আমি চাই সৌন্ধর্য্য আর গন্ধ!
এসিড ঝলসানো শরীরের যন্ত্রণা, শ্বশুর বাড়ীর গরম খুন্তির ছ্যাঁকা খাওয়া কিশোরী বধু কাজের মাধ্যমে স্বর্গীয় সুখ আছে তা ভোগ করার সব ক্ষমতা সে হারিয়েছে। সে কেমন করে বুঝবে কাজেও স্বর্গীয় সুখ আছে।
রাতে খাওয়ার পর হাটছিলাম। পথে ‘বাঁচতে শেখা’ এর একটি মেয়ের সাথে আলাপ হলো। নামটি ইচ্ছে করেই উল্লেখ করলাম না। তাঁর বাড়ী যশোর জেলার একটি গ্রামে। বাবা কৃষি শ্রমিক। সংসারে বাবা-মা ছাড়াও আছে ৩ বোন ১ ভাই। মেয়েটি বড়। কৃষি শ্রমিকের বছরে ৬ মাস কাজ থাকে না। রোজগারবিহীন বাবার সংসারে কোন্ দিন সে তিনবেলা ভাত খেয়েছে তা তাঁর মনে পড়ে না। হঠাৎ মা মারা গেল। পাশের গ্রামের এক হেরোইন খোর এর সঙ্গে বাবা মেয়েটির বিয়ে দিলেন। বিয়ের পর ২ সপ্তাহ ভালোই কাটছিল। পরের কাহিনী তার মুখেই শুনুন-
- ‘বাপের বাড়ী যা এবং ১০,০০০ (দশ হাজার) টাকা ছাড়া ফিরে আসবি না’। স্বামী ধমকের সুরে বললো।
- ‘বাবা গরীব, তাই আপনার সাথে আমার বিয়ে দিয়েছে। এত টাকা কোথায় পাবে?’ অস্পষ্ট স্বরে মেয়েটি বললো।
সেদিন স্বামীর সাথে আর কোন কথা বাড়েনি। মেয়েটি মনে মনে খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল তাঁর স্বামী তাঁকে বুঝতে পেরেছে। রাত এলো। মেয়েটির স্বামী বাড়ী আসছেনা। শংকায় জড়সড় হয়ে বারান্দায় বসে আছে। ভাবছে স্বামী দেবতার বুঝি কিছু হয়ে গেল। না দেবাতটি বাড়ী ফিরলো। সঙ্গে অন্য একজন পুরুষ। বাড়ীতে ঢুকেই বললো-
- ‘তোর বাবার যখন টাকা নাই, তখন আর কি করি। উনাকে ঘরে নিয়ে যা। এ ক’দিনের হেরোইন এর টাকা বাকি পড়ে গেছে।’ স্বামীটির কঠোর উক্তি।
আপত্তি করায় আঘাত, তারপর সঙ্গাহীন অবস্থা। ক’দিন উপোস, তারপর এ্যাঞ্জেলা গোমেজের প্রাসাদে ঠায় মিললো তা তারও জানা নাই। পরনে নতুন কাপড়, সকালে ঘিয়ে ভাজা পরোটা, দুবেলা মাছ ও মাংস দিয়ে গরম ভাত। এখানে ৬ বছর কেটে গেছে। এ্যাঞ্জেলা গোমেস এখন তার দেবতা। সে ইচ্ছা করলেই এ্যাঞ্জেলা দিদির কাছে যেতে পারে। এত সুখ স্বাচ্ছন্দ তারপরও মেয়েটি এখানে আজীবন থাকবে ভাবতেও পারে না। সে চলে যেতে চায়।
- ‘তুমি চলে যেতে চাও কেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
- ‘শুধু ভাত কাপড়ই কি সব স্যার?’ কথাটি উচ্চারণ করেই লজ্জা ঢাকার জন্য মুখে কাপড় টেনে আড়ালে চলে গেল।
মেয়েটি নরক থেকে এসেছে। আবার নরকেই ফিরে যেতে চায়। মৃত সন্ত্রাসী কাজ চায়। কেন এমন?