চরকা কি জানি। সুতা কাটার যন্ত্র। চরকায় তেল দিতে হয়। চরকা সচল রাখতে হলে নিজের গরজেই তেল দিবো। তবুও ছোটবেলা থেকেই শুনছি। ‘‘নিজের চরকায় তেল দাও। আমার চরকা নাই। আমি সুতো কাঁটি না। তবুও লোকে বলে নিজের চরকায় তেল দাও বাপু। অন্যের চরকার দিকে না তাকালেও চলবে। আমার চরকা কোথায় যে তেল দিবো। তাছাড়া আমি অন্যের চরকার দিকে তাকালাম কখন। আমার কথা শুনে তাঁরা আমাকে বোকা ভেবে, কথা বাড়ায় না।
১৯৬৫ সালে পাক ভারত যুদ্ধ শুরু হলো। বাড়ী ভারতীয় সীমান্তের খুব কাছে। আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। ভয়ে আতংকে রাত কাটাচ্ছি। মারার উপর খাড়ার ঘা। লবণ, কেরাসিনের দাম বেড়ে গেলো। গ্রামে আমরা এ দুটো জিনিষ নিয়মিত কিনি। যুদ্ধ তাই বাজারে বিরামহীন আড্ডা চলছে চা দোকানগুলো গমগম করছে। রাজা উজির ‘মারা’ হচ্ছে। আড্ডার এক বড় ভাই বললেন।
‘‘- আমাদের সেনাবাহিনী ভারতকে মেরে তক্তা বানিয়ে দিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে দিল্লী গিয়ে পৌছাবে।’’ চা
দোকানী মুচকি হেসে বললেন;
‘‘- ওরা কোথায় পৌছাবে এতে আমাদের কি লাভ। জিনিসপত্রের দাম আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। বাঁচবো কি খেয়ে’’।
জবাবে আরেকজন দোকানীকে গালি দিলেন।
‘‘- দেশ লড়াই করে জিতছে। ওনার ভালো লাগে না। শালা শুয়ারের বাচ্ছা, ভারতের দালাল।’’ দোকানী জানালেন;
‘‘- গালি দিচ্ছেন, কেন? দালালী ফালালি করি না। পেটে ক্ষুধা তাই কে হারলো কে জিতল এতে মন ভরে না ।
আমিনা না খেয়ে আছি।’’ কেউ দোকানীর কথা শুনছে না। এক কোনায় বসা এক বৃদ্ধ দোকানীকে বললেন;
‘‘- এসব বাদ দিয়ে নিজের চরকায় তেল দাও। এক কাপ লাল চা দাও।’’ দোকানী তাঁর পেয়ালা, কেতলীর দিকে
মনোযোগ দিলো। দোকানীর চরকা কোথায়? সে কিসে তেল দিবে? বৃদ্ধ কেন দোকানীকে নিজের চরকায় তেল
দিতে বললেন। কিছুই বুঝলাম না। বাংলা তাও বুঝিনা। বাংলার বাগধারা, সমাস, প্রত্যয় মাঝে মধ্যেই
ঝামালায় ফেলে দেয়। ওয়ালিদ
স্যার বাংলা পড়ান। তিনি কোন কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাইলে আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে চোখে দেখেন না।
জিজ্ঞাসা করলেন;
‘‘- রফিক! ব্যাস বাক্যসহ সমাসটা কি বল, ‘‘নিশিকুটুম্ব’’। আমার জানা নাই। দাঁড়িয়ে আছি দেখে তিনি বলরেন;
‘‘- জানা নাই বললেই পারিস না। তালগাছের মত দাড়িয়ে আছিস কেন!’’ জবাব দিলাম;
‘‘- জী স্যার।’’
‘‘- জানিস না ঠিক আছে।’
‘‘- বলা অরিন্দম কোন সমাস।’’ ওয়ালিদ স্যারের নতুন প্রশ্ন। ভাগ্য ভালো জবাবটা জানা। খুব তাড়াতাড়ি জবাব
দিলাম।
‘‘- অরি মানে সাপ-শত্রু, দমন মানে শাসন। অরিন্দম মানে শক্র বা শাসন কোনটাই নয়। অরিন্দম মেঘনাদ এর
অপর নাম। বহুব্রীহি সমাস।’’ জবাবে বললেন;
‘‘- তাহলে নিশিকুটুম্ব কোন সমাস জানিস না কেন?’’
‘‘- মাথা নীচু করে দাড়িয়ে রইলাম।’’
ওয়ালিদ স্যার এবার জানতে চাইলেন;
‘‘- এবার বুঝেছিস এটা কোন সমাস ?’’
‘‘- এখন বুঝেছি এটাও বহুব্রীহি সমাস। তবে ব্যস বাক্যটা জানি না।’’ জবাব দিলাম;
‘‘- হঠাৎ মঞ্জুর ফাল পেড়ে উঠলো, ‘‘নিশি ও কুটুম্ব।’’
ওয়ালিদ স্যার বললেন;
‘‘- মঞ্জুর, নিজের চরকায় তেল দে বাবা। এটা ব্যাসবাক্য হলে বহুব্রীহি হবে না হবে দ্বন্দ্ব সমাস। এটা ঘর ও বাড়ী ,
ঘরবাড়ী নয়। নিশিকুটুম্ব মানে চোর, বুঝলি। ব্যাসবাক্য, নিশিতে আসে সে কুটুম্ব।
সুতা কাঁটতে চরকা ঘোরাতে হয়। চরকা ঘুরানো কষ্টের কাজ। কষ্ট কমাতে চরকায় তেল দিতে হবে। লোকে চরকায় তেল দিতে বলে নিজের কষ্ট কমানোর জন্য। সোজা ভাবে কথা গুলো বলা যায়। লোকে বলে না। কেন জানি সবাই বাকা করে কথা বলে।
‘‘- নিজের চরকায় তেল দাও।’’
নিজের কাম নিজে কর। কোথায় কি হচ্ছে এটা নিয়ে মাথা খারাপ করে লাভ নেই। নিজে বাচঁলে বাপের নাম। সবাই এসব কথা বলে আবার সবাই অন্যের চরকায় তেল দেয়। তেল দেয়া আমাদের অভ্যাস। লোকে বলবে তাই বলে অন্যের চরকায় তেল দেব না, এ কি হয়। তাহলে আমরা কি করব. যাঁদের চরকা নাই। তাই আমরা চরকা পেলেই তেল দিব। চরকা নিজের হোক আর পরের আমাদের তেল দেয়ার কাজ তেল দিব। তাতে ওদের কী?।
নিজের চরকায় তেল দাও। মানে বুঝলাম ষষ্ঠ শ্রেণীতে। ওয়ালিদ স্যার ষষ্ঠ শ্রেণীতে বাংলা ব্যাকরণ পড়াচ্ছেন। বিষয় বাংলা বাগদারা। প্রশ্ন করলেন;
‘‘- নিজের চরকায় তেল দাও। মানে কি? জবাবে আমরা কিচমিচ করছি।’’ তিনি নিজেই জবাব দিলেন।
‘‘- নিজের কাজ নিজে কর। অন্যকে নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নাই।
ওয়ালিদ স্যারের কাছ থেকে জানলাম এটা একটা বাগধারা। বাগধারা হলে শব্দের ভিতর মানে খুজে লাভ নাই। মানের সংগে তেল বা চরকার কোন মিল নাই। বাংলায় কথা বলতে ভালো লাগে। মায়ের ভাষা, আমরা এই ভাষার জন্য বাহান্নের ২১শে ফেব্রুয়ারী জীবন দিয়েছি। ২১শে ফেব্রুয়ারী আজ বাংলার আকাশ পেরিয়ে বিশ্বের আকাশে; আমর্ত্মজাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমরা নিজের কাজ করি না। অন্যের চরকায় তেল দেই। এলোমেলো সব ভাবনা আমার মাথাটা খারাপ করে দিলো। মাথায় কত প্রশ্ন আতিপাতি করে জবাব খুঁজছি।
‘‘- অন্যের চরকায় তেল দেই কেন’’?
‘‘- সবাই কী তাই করে? কেন করে?’’
আমরা নিজের কাজ করি না কেন? কোন জবাব পাচ্ছি না। অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসলো। হঠাৎ নন্দলালের কথা মনে পড়ল।
- ‘ নন্দের ভাই কলেরায় মরে। দেখিবে তাহারে কেবা, সকলে বলিলো, যাও না নন্দ কর না ভাইয়ের সেবা।
নন্দ কহিল ভাইয়ের জন্য জীবনটা যদি দি তাহলে অভাগা দেশের হইবেটা কি?’
আমরা নন্দলালরা অন্যের চরকায় তেল দেয়। নন্দের কাছে নিজের চরকা তেমন গুরুত্ব বহন করেনা। অন্যের চরকাটা সচল থাকলেই চলবে। তাই আমরা অন্যের চরকায় তেল দিয়ে বেড়াই।
১৯৬৯ দিকে ১১ দফার ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গেঁ। ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী অগ্নিকন্যা মতিয়া চেীধুরী রাজশাহীর গোদাগাড়ী মহিষালবাড়ী গরুর হাটে জনসভা করে গেলেন । মন্ত্রমুগ্ধের মত লাখো জনতা অগ্নিকণ্যার কথা শুনলো। পরের দিন ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন গোদাগাড়ী স্কুলে এসে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে গেল। আমি সংগ্রাম পরিষদের ‘ন্যাতা’। নিজের মধ্যে কেউকেটা কেউকাটা ভাব এসে গেলো। সিদ্ধান্ত নিলাম।
‘‘- গোদাগাড়ীতে কিছু একটা করতে হবে।’’
স্কুল বাদ দিয়ে উৎসাহী ছেলেদের নিয়ে মিছিল মিটিং করছি। স্কুলে উপস্থিতি কমেছে। মিছিলটা লম্বা হচ্ছে। নিজেকে বড় নেতা ভাবতে শুরু করলাম। শাহজাহান মাষ্টার, স্যাঁর ডাক দিয়ে বললেন;
‘‘- বড় নেতা হয়েছিস, ভালো। নিজের চরকায় তেল দে।’’ স্যারের কথায় আঁতে ঘা লাগলো।
জবাব দিলাম;
‘‘- আমার চরকায় আমি তেল দিচ্ছি। আপনি আপনার চরকায় তেল দেন।’’
ছাত্র আন্দোলনের নেতারা দেশব্যাপী হরতালের ডাক দিয়েছে। সিদ্ধান্ত নিলাম গোদাগাড়ীতে হরতাল পালন হবে। কোন দোকানপাট খুলবে না। কোন মটরযান চলবে না। ডাংগপাড়ার উপর দিয়ে রাজশাহী চাপাঁই নবাবগঞ্জ হাইওয়ে। সারা দিনে ৪ টি মুড়ির টিন আসা যাওয়া করে।
দোকান পাট বলতে ডাংগাপাড়া ও হাট পাড়ায় কয়েকটা মুদি দোকান। মনে মনে ঠিক করলাম কোন মুদি দোকান খুললে একটা দফা রফা করতে হবে। মুড়ির টিনগুলো রাস্তায় নামলে কোন কথা নাই। আগুন জালিয়ে দিবো। কেরসিন, পুরানা কাপড়. দেয়াশলাই রেডি করে রাখলাম। কয়েকজন মুদি দোকানদার এসে ঘুরে গেল। আমাদের রুদ্র মুর্তি দেখে দোকান খোলার সাহস করলো না। বাড়ী ফিরে গেলো। হয়তো বউ এর চরকায় তেল দিচ্ছে। এত প্রস্ত্ততি এত আয়োজন কোন কাজে লাগছে না। মুদি দোকান খুললো না। একটা মুড়ির টিন রাসত্মায় নামেনি। কিছু করতে পারছি না। বড্ড অস্থীর লাগছে। রইশ উদ্দিন স্কুলের তালা খুঁলেছিলেন। শাহজাহান স্যার একজন ছাত্রী নিয়ে ক্লাশেও এসেছেন। খবর শুনে দলবল নিয়ে স্কুল গেলাম । স্যার আগেই চলে গেছেন। রইশ উদ্দিন, স্কুল বন্ধ করে বাড়ী চলে গেছে। এত প্রস্ত্ততি কোন কিছুই দেখাতে পারলাম না। নিজের উপর ভীষন রাগ হচ্ছিল। একটা মোকা পেয়ে গেলাম।
ভাংগপাড়ার একমাত্র মিষ্টির দোকান, ঝাঁপ খোলা। কড়াই ভর্তি দুধ জ্বাল হচ্ছে। এখন ছানা, রাতে মিষ্টি তৈরী করা হবে। দলবল নিয়ে গিয়ে কড়াই ভর্তি দুধ কাঠের ছুলোয় ঢেলে দিয়ে বীরত্ব দেখালাম। দোকানের মালিক দাউদ ভাই। গোদাগাড়ী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাহেবের পাড়ার লোক। গালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে বিলাপ করছেন।
‘‘- হামাকে কোন ভুতে ধরেছিল যে দোকান খুললাম। এ্যারা আমার এত বড় সর্বনাশ করতে পারলো।’’
বীরত্ব দেখাতে গিয়ে কাজটা করে ফেলছি বটে, তবে খারাপ লাগছিল। তাড়াতাড়ি কেঁটে পড়লাম। দাউদ ভাই চেয়ারম্যান সাহেবকে নালিশ করলেন। তিনি আমাকে চেনেন। ভালোও বাসেন। পরিষদে ডেকে পাঠালেন। পরিষদে নিয়ে শাসিয়ে বললেন;
‘‘- তুমি তুফানী ভাই এর ছেলে। তাই ছেড়ে দিলাম। দাউদকে তাঁর দুধের দাম দিয়ে দিবে।’’ আগে থেকেই
আমার ভিতর অপরাধ বোধ কাজ করছিল। বললাম;
‘‘- আচ্ছা ! দিয়ে দিবো।’’
চেয়ারম্যান সাহেব নির্দেশ দিয়েই নিজেকে জাহির করতে লাগলেন;
‘‘- তোমরা জানো আমি গোদাগাড়ির গর্ভ। দেশের গর্ভ। আমি দেশের শ্রেষ্ঠ চেয়ারম্যান। আমার নেতা ফিল্ড
মার্শাল আইয়ুব খান আমাকে পাকিস্তানে নিয়ে গেছেন; মেডেল দিয়েছেন। আমার এলাকায় এসব কি হচ্ছে?
আমি এসব বরদাস্ত করব না। তোমরা ছাত্র, পড়াশুনা কর। নিজের চরকায় তেল দাও।’’
‘‘- চেয়ারম্যান সাহেবের কথা শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল।
জবাবে বললাম;
‘‘- দাউদ ভাই এর দুধের দাম দিয়ে দিবো। এ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি কার চরকায় তেল দিবো;
এটা আমার উপর ছেড়ে দিন।’’ আরও জানিয়ে দিলাম;
‘‘- শুনুন; আমার চরকায় আপনি আর তেল দিতে আসবেন না। ভালো হবে না;।’’ আমার প্রতিক্রিয়ায়
চেয়ারম্যান সাহেব ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার দিলেন;
‘‘- ভবিষ্যত ভালো হবে না, বলে রাখলাম।’’
‘‘- ভালো খারাপ, ভবিষ্যতে দেখা যাবে। আপনি আপনার মত থাকেন। আমি আমার মত থাকবো। মানে
আপনি আপনার চরকাই তেল দিন, আমি আমার চরকাই তেল দিবো; এটাই মঙ্গল।’’
ইউনিয়ন পরিষদ ছাড়লাম। পরদিন দাউদ ভাইকে দুধের দাম দিলাম। নিতে চাইছিলেন না। বোধ হয় ভয় পেয়েছেন। নেতাকে সবাই ভয় পায়। এর মাঝে ১১ দফার ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যোগ হয়েছে আওয়ামীলীগের ৬ দফা আন্দোলন। সব কিছু মিলে এক ছাত্র জনতার মহামিলন। চেয়ারম্যান, মেম্বার সাহেবরা পাড়ায় পাড়ায় ওঠান বৈঠক করছেন। কৃষক তাঁর জমি আর বাড়ীঘর নিয়েই আছে। তাঁদের নিয়ে চেয়ারম্যান, মেম্বারদের মাথা ব্যাথা নেই। সব মাথা ব্যাথা ছাত্র আর বেকারদের নিয়ে। তাঁরা দিনরাত আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে শ্লোগান দিচ্ছে।
‘‘- জেলের তালা ভাংগবো, শেখ মুজিবকে আনবো।’’
চেয়ারম্যান সাহেব আমাদের বোঝাচ্ছেন;
‘‘- তোমরা ছাত্র। তোমাদের কাজ লেখাপড়া করা। লেখা পড়া কর। নিজের চরকায় তেল দাও। আন্দোলন,
বিপ্লব এসব কেন? ’’
কে শোনে কার কথা। তাঁরা হেদায়েত করছেন। বড়রা ভয়ে, তাদের ক্ষমতার দাপটে মাথা নত করে সাঁই দিচ্ছেন।
‘‘- ঠিক বলছেন, চেয়ারম্যান সাহেব। দেখছেন এই বেআদবের কান্ড। সে দিন আপনার মুখের উপর কি বলে
গেল। পড়াশোনা বাদ দিয়ে আন্দোলন করছে। পাকিসত্মান আর্মি কি জানে না। দেশে মার্শাল ‘ল’ চলছে। তাঁরা
কি মনে করেছে।’’
অভিভাবকগণ ছেলেদের বোঝাচ্ছেন;
‘‘- দেখ বাবা দেশে মার্শাল‘ল’। সারা দেশে মিলিটারী টহল দিচ্ছি।কখন কী করে কে জানে? তোরা এসব করিস
না। আমাদের ভয় করছে।’’ ছাত্রদের রক্তে আগুন ঝরছে। এ আগুন মা-বাবার এসব কথায় নিভবে না।
পাক ভারত যুদ্ধের খরচ মেটাতে মুদ্রাস্ফীতি আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। বাড়তি ধান দিয়ে বাবা ছেলের পড়ার খরচ চালাতে পারছে না। ডগবগে রক্ত নিয়ে ঘরে বসে থাকবে কি করে? ছেলে বাবাকে বলে;
‘‘- পড়াশুনাও হলো না। খরচ জোগাতে পারোনি বলে। চায়ের আড্ডায় শুনে ছিলাম আমাদের সেনাবাহিনী দিল্লী
ছুই ছুই করছে। এখন শুনছি ভারত শেয়ালকোটে পাকিস্তানের জায়গা দখল করে নিয়েছে।’’
বাবা রেগে গিয়ে ছেলেকে বললেন;
‘‘- এসব কি বলছিস বাবা। তোঁকে এসব কে শিখিয়েছে।’’ জবাবে ছেলে বলে;
‘‘- কে শিখাবে বাবা নিজেই তো শুনছি। পড়ছি ।’’
‘‘- তুই ঠিক জানিস না বাবা। পাকিস্তান আর্মি অপরাজেয়, ওদেরকে কেই হারাতে পারবে না।’’
বাবা ছেলেকে বোঝাচ্ছেন।
‘‘- বাদ দাও, বাবা। নিজের চরকায় তেল দিতে বলছিলে। বলেছিলে পড়াশূনা করতে; করছিলাম। ১৯৬৫ পাক
ভারত যুদ্ধ আমার চরকাটাও কেড়ে নিয়েছে। বাবা ! তেল দিবো কিসে?’’ ছেলের কথাশুনে বাবার চোখ থেকে
জল গড়িয়ে পড়লো।
একটা চরকা কেড়ে নিলেও আরেকটা চরকাহসে পেয়েছে, আন্দোলন। নিজের হোক আর পরের হোক চরকা যখন পেয়েছে। তেল সে দিবে। নিজের জীবন সহজ না হলেও অন্য এক জনের জীবন সহজ করতে আপত্তি কোথায়? বাবা কোন কথা না বলে বাড়ির ভিতর চলে গেলেন। ভিতরে ঢুকে মাকে বলছেন;
‘‘- ওগো শুনছো। ছেলেকে একটু বোঝাও।’’ জবাবে মা বললেন;
‘‘- আমি কি বলবো বলো। আগে কোন দিন এ নিয়ে তুমি আমাকে কিছু বলো নি। আজকে বলছো কেন?।’’
‘‘- তোমাকে দিয়ে কিছু হবে না।’’ রেগে নিজের ঘরে গিয়ে বাবা শুয়ে পড়লেন। কজন বাউল গান গাইছেন।
একতারার টুংটাং শব্দ শোনা যাচ্ছে।
‘ দেহ ঘড়ি চৌদ্দতলা, কোন মিস্ত্রি বাঁনায়াছে............................’’
বাউল নিজের চরকায় তেল দিচ্ছেন। বাবা গান শুনে বাহির হলেন। হতাস হয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছেন। কে যেন বলছে;
‘‘- তেল দেয়া যার অভ্যাস। সে তেলে দিবেই। চরকা পেলেই হলো।’’
Md. Rafiqul Islam, PhD. | ||