অষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় ১৭-২১ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সি এর জেনারেল এ্যাসেম্বলী। প্রতি বছর এ আসর বসে। বাংলাদেশ এই এজেন্সির সদস্য। প্রতিবছর এখানে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। এ বছরও অংশ নিবে। এবারের অংশ গ্রহণ একটু আলাদা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এ নিয়ে এজেন্সির সাথে কনফারেন্সের সাইড লাইনে সবার সংগে আলোচনা করা লাগবে। একই সংগে রাশান ডেলিগেটের সংগে হাই হ্যালো করতে হবে।
বাংলাদেশের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঠিক করা হয়েছে। দলের একটা অংশ রিজিওনাল কনফারেন্সে অংশ নিয়ে পরে মূল দলের সংগে যোগ দিবে। বাংলাদেশ পারমানবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে এক দল ১১ সেপ্টেম্বর ভিয়েনা পাড়ি জমালেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের নেতৃত্বে আমরা আরব আমিরাতের একটি বিমানে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১২ ভিয়েনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবো। রাশিয়ায় বাংলাদেশ দূত ও জেনেভা থেকে রাষ্ট্রদূত যোগ দিবেন।
সকাল ৭-৩০ টায় প্রটোকল অফিসার পাসপোর্ট-ব্যাগ নিয়ে গেলেন। ৮-০০ টার দিকে এয়ার পোর্টের দিকে রওয়ানা দিলাম। রাস্তা ফাঁকা, পৌনে নয়টায় পৌঁছে গেলাম। ভিআইপি গেটেই মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে দেখা হলো। অতিরিক্ত সচিব আসাদ, মন্ত্রী মহোদয়ের সহকারী একান্ত সচিব, পিআরও আগে থেকেই বসে ছিলেন।
ভিআইপি লাউঞ্জে চা খেতে খেতে পাশপোর্ট, ইমিগ্রেশন, ব্যাগ পাঠানো, বোর্ডিং পাশ হয়ে গেলো। আমরা নির্ধারিত সময়ে রওনা দিলাম।
দুবাই এয়ারপোর্টে সেখানকার দূতাবাসের কেউ ছিল না। জিজ্ঞাসা করে বিজনেস ক্লাসের লাউঞ্জ খুজে সেখানে ৫ ঘন্টা কাটালাম। সিকিউরিটির বাড়াবাড়ি থাকলেও কোন অশোভন কিছু ছিল না।
ঢাকা থেকেই দুবাই ভিয়েনার বোর্ডিং পাশ করা ছিল। সিকিউরিটি চেক করে বিমানে চাপলাম। সাড়ে পাঁচ ঘন্টার ফ্লাইট, ভিয়েনা পৌঁছলাম। এডভ্যান্স পার্টি বিমান বন্দরে থাকবে, দূশ্চিন্তা নাই। লাগেজ নিয়ে বাহির হলাম।
অষ্ট্রিয় সময় রাত ১০.০০ টায় ভিয়েনা আর্ন্তজাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। রিজিওনাল কনফারেন্সে আসা কর্মকর্তা ও স্থানীয় কিছু লোকজন আসবেন বলে জানতাম। এমিরাট বিমান থেকে নেমে লাগেজ নিয়ে মূল ফটকে নামলাম। কেউ নাই। অবাক হলাম। আশে পাশে খোজা হলো। কাউকে না পেয়ে টেলিফোনের উপর ভর করলাম। ভাগ্যভালো ঢাকা থেকে আসার সময় সরকারী সেলফোনটি আর্ন্তজাতিক রোমিং করে এনেছিলাম। টেলিফোন পেয়ে অভ্যার্থনা জানানো পার্টি এসে পৌঁছলো। মন্ত্রী মহোদয় অনুযোগের সাথে বললেন;
‘‘কি মিয়া, মানুষ খুজতে এসেছেন, না গরু খুজতে!’’
খুচরা কিছু কথা বার্তার পরে হোটেল এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আইএইএ-এর সাবেক কর্মকর্তা শহীদ সাহেব, আইএইএ কর্মকর্তা রহিম সাহেব, ভিয়েনায় বসবাসরত মঞ্জু সাহেব নিজ নিজ গাড়ী নিয়ে এসেছেন। শহীদ সাহেব এর লাল রং-এর ফিয়াট ৫০০ গাড়ীতে করে মন্ত্রী সাহেব আর আমি রওনা হলাম। শহীদ সাহেব গাড়ী চালাচ্ছেন। হোটেল পার্ক ইন এ আসলাম। রুম বরাদ্দ পেয়ে ২২২ নম্বরে উঠলাম। কর্মকর্তা, শহীদ, রবীন ও মঞ্জু সাহেব রুমে আসলেন। খুচরা আলাপ হলো। একে একে সবাই বিদায় নিলেন। রাত ২.০০ টা, রুমে শুধু শহীদ সাহেব আর আমি।
‘‘এখন বাংলাদেশে সকাল ৬.০০টা। ঘুম আসছে না। দানিউব এর পাড় ঘুরে আসলে ভালো হতো।’’প্রস্তাব করলাম।
‘‘যাবেন নাকি? চলেন ঘুরে আসি।’’ শহীদ সাহেব সানন্দে প্রস্তাব গ্রহণ করলেন।
গেঞ্জি গায়ে দিয়ে, জুতা পালটিয়ে সংগে আনা কেটস পরে নিলাম। তাঁর গাড়ীতে করে দানিউব এর পাড়ে গেলাম। গাড়ী পার্ক করে পাড় দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। শহীদ সাহেব এর বয়স প্রায় সত্তর এর কোঠায়। ৭১ সালে লেখাপড়ার জন্য জার্মানী এসেছেন, আর দেশে ফেরেন নি। পরে আইএইএ’তে যোগদান করে অবসর নিয়েছেন। এখন সেখানেই পরামর্শক হিসাবে কাজ করেন। পাড়ের পাশে গড়ে উঠেছে ক্লাব, হোটেল, এমনকি নূড পার্ক, কিছুই বাদ পড়েনি। প্রায় ৪ কিলোমিটার হাঁটা হয়েছে। শহীদ সাহেব বললেন, সারা রাত জার্নি করে এসেছেন। চলেন ফেরা যাক। ভুলে গেছিলাম, শহীদ সাহেবের বয়স হয়েছে। তাঁকে এ কষ্ট দেয়া ঠিক হয়নি। তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি জানালাম;
‘‘সরি শহীদ ভাই। আগেই ফেরা উচিৎ ছিল। চলেন ফেরা যাক।’’
শহীদ সাহেব আমাকে পার্ক ইন এ নামানোর আগে গাড়ীতে করে কিছু দূর ঘুরিয়ে আনলেন। দানিউব আগে ভিয়েনা শহর থেকে দূরে ছিল। বন্যায় একটা নতুন চ্যানেল তৈরী হয়েছে। নতুন বন্যার হাত হতে রক্ষার জন্য একটা নতুন চ্যানেল তৈরী করা হয়েছে। চ্যানেলগুলোর উপর নতুন সাঁকো তৈরী করেছে। সাঁকোগুলো পাড়ি দিয়ে এলাম। পাড়ের একটা বড় চার্চ দেখিয়ে শহীদ সাহেব বললেন;
‘‘সমাজতন্ত্রের পতনের আগে বুলগেরিয়া, রোমানিয়া, হাংগেরী, চেকোস্লোভাকিয়া থেকে নাগরিকরা জিনিসপত্র এনে চার্চের পাশে ‘মাছি বাজার’ বসিয়ে বিক্রি করতো। কম দামে অনেক জিনিসপত্র পাওয়া যেত। এখন আর নাই।’’ শুনে বললাম;
‘‘আগে তাঁরা দারিদ্র বিক্রি করেছে চার্চের আশে পাশে। এখন তাঁরা সব কিছু বিক্রি করছে ইউরোপজুড়ে। ঘরে ঘরে।’’শুনে শহীদ সাহেব মুচকি হেঁসে বললেন;
-‘‘এছাড়া তাদের আর কিবা করার আছে।’’
কোন জবাব দিতে পারলাম না। একটা দীর্ঘ শ্বাস বুক চিরে বাহির হলো। হোটেল গেটে আমাকে নামিয়ে দিয়ে শহীদ সাহেব বিদায় নিলেন। সকাল ৪.৩০ মিনিট। ঘুম আসছে না। রুমে যাবো কি না ভাবছি। সিদ্ধান্ত নিলাম, একটু হাঁটা হাঁটি করবো। অন্য হোটেলটা পায়ে হাঁটা দূরত্বে। কনফারেন্স ভেন্যুর দূরত্ব মিনিটে মেপে পার্ক ইন এ ফিরলাম। টিভি দেখছি, আইপ্যাডে ওয়াই-ফাই সংযোগ দিতে দিতে সকাল ৮.০০ টা বেজে গেল। নাস্তা খেতে নিচে নামলাম। রহিম সাহেব জানালেন,
-‘‘স্যার, পাশের জন্য ছবি তুলতে এজেন্সিতে ২.০০টার সময় যেতে হবে।’’
মন্ত্রী মহোদয় প্রস্তাব করলেন -‘‘বসে বসে না থেকে চলেন যাই, কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’’ রহিম সাহেব বললেন,
‘‘স্যার, কোথায় যাবেন?’’ উত্তরে মন্ত্রী মহোদয় বললেন, ‘‘চলেন যাই, মিউজিক কমপোজার মোৎসার্ট এর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। ’’
রহিম সাহেব সংগে সংগে সাঁই দিলেন;
-‘‘চলেন স্যার। ’’
রহিম সাহেবের গাড়িতে করে মন্ত্রী মহোদয়, রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী, ফিরোজ ও আমি মোৎসার্ট এর বাড়ীর দিকে রওনা হলাম।
সাদা মাটা একটা ফ্লাট বাড়ি, ঢুকার জন্য টিকিট কাটতে হলো। টিকিট এর সংগে একটা ইলেকট্রনিক টুর ডিভাইস দেওয়া হলো। তা নিয়ে তিন তলা থেকে মোৎসাট এর জীবন কাহিনী শুনতে শুনতে তার জীবনের সংগে যুক্ত কিছু জিনিষ পত্র দেখতে দেখতে নিচ তলায় ফিরে আসলাম । জিনিষপত্র গুলো মোৎসাট ব্যবহার করছেন কি না এ নিয়ে সন্দেহ আছে। নিচে একটা দোকান, মোৎসার্ট কে নিয়ে বাণিজ্য। এমন কিছু নাই যাতে মোৎসার্টকে বাণিজ্যিকীকরণ করা হয়নি। দেখে নিজেকে জিজ্ঞাসা করলাম ।
আমরা কি এ ভাবে কোন কিছু বাণিজিকীকরণ করতে পেরেছি? কোন জবাব খুজে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়লো,
হ্যাঁ । কুমিল্লা মাতৃভান্ডারকে শোকেস করতে পারলেও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবননন্দ দাস, মধু, ঈশ্বর কনার জনক বোসকে নিয়ে বানিজ্য করার কথা কোন দিন ভাবিনি।
মোৎসার্ট এর বাড়ি, ভিয়েনা শহরের ঐতিহাসিক ভবন গুলো দেখে পার্ক ইন এ ফিরে আসলাম । ১-৫০ মিনিটে হাঁটতে হাঁটতে ভিয়েনা ইন্টারন্যাশনাল সেন্টারে আসলাম। কনফারেন্সে অংশ নেওয়ার জন্য পাশ লাগবে। পাশের জন্য ছবি তুলতে হবে। ঢুকতে সিকিউরিটির কাজ কারবার আমাকে ধাক্কা দিলো। বেল্ট, কোট খুলতে হলো। কয়েক মিনিটের মধ্যে ছবি তোলা, কার্ড তৈরী, সব কিছু শেষ । সিকিউরিটির বাড়াবাড়ি দেখে মেজাজ খারাপ হলেও, কার্ডটি এভাবে পেয়ে যাওয়ায় খুশি হলাম। কর্তব্যরত মহিলাকে ধন্যবাদ জানালাম,
‘‘ডানকে শওন’’।
ভদ্র মহিলা মুচকি হেঁসে জবাব দিলেন। আইএইএ কার্ড নিয়ে আমরা পার্ক ইন এ ফিরে আসলাম। রহিম সাহেব ফিরোজকে নিয়ে ডিপার্টমেন্টাল সপে গেলেন। চাল, ডাল, মাছ ও বেগুন কিনতে। রান্না, খাওয়া-দাওয়া হবে। রহিম সাহেব চীফ কুক, ফিরোজ জোগালী। রহিম সাহেব ফিরোজ চাল, ডাল, মুরগী, টুনা, বেগুন নিয়ে ফিরলেন।
মন্ত্রী মহোদয় আমাদের নিয়ে পার্ক ইন এর লবিতে আড্ডা দিচ্ছেন। মস্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত যোগ দিলেন। মন্ত্রী মহোদয় কফি খাওয়ালেন। আড্ডা শেষে রুমে গেলাম। রাতের খাবার খেতে ডাক পড়লো। রান্না হয়েছে নীচ তলায় জাফরের রুমের বারান্দায়। বাংগালী রান্নার তীব্র ঘ্রান।
মন্ত্রী সাহেব এলেন। প্লেটে ভাত, টুনা, বেগুন ভাজা, বাটিতে মুরগী ঝোল । খাওয়া শেষ, গল্প চলছে, জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এসে যোগ দিলেন। কথা বার্তা শেষে তিনি বিদায় নিলেন। আমরাও আস্তে আস্তে নিজ নিজ রুমে আসলাম। পর পর দু দিন নির্ঘুম, টিভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়লাম। অভ্যাস মত সকাল সাড়ে পাঁচটায় ঘুম ভাঙগলো। কাজ কর্ম শেষে নাস্তার জন্য বাহির হলাম। আমার সামনের রুমে আছে দীলিপ, অতিরিক্ত সচিব। তাঁর রুমে টোকা দিলাম। না পেয়ে একাই নিচে নামলাম। দীলিপ নাস্তা খাচ্ছে। সে জানালো;
‘‘মন্ত্রী মহোদয় নাস্তা খেয়ে চলে গেছেন। ’’
দীলিপ বসে রইল। নাস্তা খেয়ে এক সংগে রুমে ফিরলাম। রবীন্দ্রনাথ জানালো,
-‘‘স্যার আমরা রওনা দিলাম। রহিম সাহেব নয়টার দিকে গাড়ী নিয়ে আসবেন। আপনাকে আর মন্ত্রী মহোদয়কে নিয়ে যাবেন।’’
মন্ত্রী মহোদয়কে জানালাম। লবিতে বসে আছি। জেনেভা থেকে আগত কাউন্সিলর নজরুল এসেছেন। তার সংগে দেখা হলো। রহিম সাহেব আসলেন। মন্ত্রী সাহেবকে নিয়ে রহিম সাহেবের গাড়ীতে জেনারেল কনফারেন্স এ ঢুকলাম, ইরানের ডেলিগেট আমাদের আগের গাড়ীতে করে ভেন্যুতে ঢুকলেন। সামনে পিছনে সিকিউরিটি, ভাব-সাব আলাদা।
কনফারেন্স শুরু হলো। এ কনফারেন্সের মূল বক্তব্য ‘‘শান্তির জন্য পরমাণু’’। আগের সভাপতি সুচনা বক্তব্য দিয়ে এলসালভাদরের রাষ্ট্রদূতকে ৫৫তম জেনারেল কনফারেন্সের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলেন। আটজন ভাইস-প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা হলো। সৌদি আরব কমিটি অব দি হোল এর প্রেসিডেন্ট নির্ধারিত হয়েছে। একের পর এক ডেলিগেট প্রধান বক্তব্য দিচ্ছেন। মন্ত্রী মহোদয় কনফারেন্স শুরুর আগে ভিয়েতনামের ডেলিগেটের সাথে কথা বললেন। রাশিয়ান ফেডারেশনের সংগে যোগাযোগ করা হয়েছে। মন্ত্রী মহোদয় রাশিয়ান ফেডারেশন প্রধানের সাথে কথা বলবেন। রবীন্দ্রনাথ যোগাযোগ করে ঠিক করেছে। রাশিয়ান ডেলিগেট প্রধান মি: কিরেনকোর সাথে মন্ত্রী মহোদয়ের কথা হবে। বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর করিডোরে আলাপটা সারতে হবে। বক্তৃতা শেষে করিডোরে কফি কর্ণারে বসলাম। কথাবার্তা শেষ হলো। আমরা কনফারেন্সে ফেরৎ আসলাম। ইরান তাঁদের বক্তব্য রাখছেন।
দু পুরে আইএইএ এর ক্যান্টিনে ইউরোপীয় সব্জি রান্না দিয়ে ভাত খেয়ে আবারো কনফারেন্সে ফিরে আসলাম। প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখছেন। আজকের অনুষ্ঠান শেষ হবে ৬-০০ টায়। ৬.৩০ টায় ডিজি এর রিসেপশন।
আইএইএ এর মহাপরিচালক, ‘আমানো’ তাঁর স্মারক বক্তৃতায় বাংলাদেশের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনে আইএইএ এর ভবিষ্যৎ সহযোগিতার প্রাপ্তির বিষয়ে আলোচনার জন্য মহাপরিচালক, উপ মহাপরিচালকের কাছ থেকে এ্যাপয়েন্টমেন্ট চাওয়া হয়েছে। এ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গেলো ১৮-০৯-১২ ও ১৯-০৯-১২তারিখে।
জাপান সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে সব কটি পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করতে চায়। বাংলাদেশ পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে চাচ্ছে। জাপান সরকারের বর্তমান সিদ্ধান্তের উপর বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে একটা টিভি চ্যানেল ইন্টারভিউ চাইল। বললাম,
‘‘এখন সাড়ে পাঁচটা। মন্ত্রী মহোদয় এখন এখানে নাই। তিনি কাল আসবেন।’’
তাদের আজকেই ব্রডকাষ্ট করতে চাই। তাই কয়েকটি কথা বলতে হলো।
জাপান সরকার পারমানবিক শক্তি ব্যবহার বন্ধ করছেন না। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ফেজ অডিট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তেল ভিত্তিক পাওয়ার দিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ জাপান করতে পারবে। তাই নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট বন্ধ করছে। দেশের উন্নয়নের জন্য কম দামে বিদ্যুৎ সরবরাহের লক্ষে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ বছর বাংলাদেশ ডেলিগেশনের বহরটা একটু বড়, মোট ১৪ জন। মন্ত্রী মহোদয়, আমি, রাষ্ট্রদূত দূজন সামনে; পিছনে বাকি সবাই বসেছেন। বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি কমিশনের শৌকতকে ৩টি ‘কি-নোট’ পেপার প্রেজেন্ট করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কমিশন তাঁকে ১৭০০ ইউরো দিবে।
শৌকতকে বললাম;
‘‘আমাদের খাওয়ান। তা না হলে টিএ ডিএ কেটে নিবো। ’’
শৌকত কোন জবাব না দিয়ে মুচকি হাঁসলো। আমি এ লিখাটি হলে বসেই লিখছি। চেয়ারম্যান জানতে চাইলেন ‘‘এটা কি?’’
জবাব দিলাম,
-‘‘আপনাদের আমলনামা।’’
রিসেপশন চলছে, মহাপরিচালক ‘আমানো’ ঘুরে ঘুরে ডেলিগেটরদের সাথে আলাপ করছেন। আমাদের সংগে আলাপ হলো। তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের ভুমিকার প্রশংমা করায় আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানালাম; তাঁর কাছ থেকে সহযোগিতাও চাইলাম। তিনি স্বানন্দে সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। রিপাবলিক অব কংগো এর ডেলিগেট, মন্ত্রীর সংগে কথা হলো। তিনি জানালেন তাদের একটি ট্রিগা রিয়াকটর আছে। তিনি কংগো পিস কিপিং ফোর্সে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রশংসাও করলেন। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সাথে আলাপ হলো। আমেরিকান ফ্রি্ল্যান্স অংশগ্রহণকারী একজনের সাথে আলাপে জানালেন;
‘‘নতুন প্রজন্মের উৎপাদনশীলতা অনেক, মানসিকতা শূণ্যের কোঠায়। ’’ ক্ষোভ দেখে তাঁকে শান্তনা দিলাম। সংগে খোঁচাও মারলাম।
‘‘দায়-দায়িত্ব শুধু তাঁদের ঘাড়ে চাপানো যায় না। দায় বুড়াদের আছে। ’’
তিনি কোন উচ্চ-বাচ্য না করে স্বীকার করলেন। এ সবের বাহিরেও আইএইএ এর অনেক কর্মকর্তার সংগে আলাপ হলো। হালকা পানীয়, স্ন্যাকস শেষে বিদায় নিলাম। রহিম ফিরোজের রান্না ঘরে আজও চুলা ঠেলছে। খিচুড়ী, পালংশাক, ডিম ভুনা হয়েছে। সবাই এক সংগে খেয়ে আড্ডা। আড্ডা শেষে রবীন্দ্র নাথ, নজরুল, শৌকত এর সাথে তাদের হোটেলে গেলাম। এক কাপ কাপেচিনো, আড্ডা শেষে বসলাম বাংলাদেশ কান্ট্রি পেপারে শেষ আচড় দিতে। নজরুল আমার মন্তব্য জানতে চাইলো। বললাম;
’’কান্ট্রি পেপারটিকে আরও স্মার্ট করতে হবে।’’
ঘন্টা খানেক পরে তারা ড্রাফট কান্ট্রি পেপারের কসমেটিক সার্জারি শেষ করলো। রহিম সাহেব, ফিরোজ এসে ঢুকছে হোটেল লবিতে, ডাক দিলাম। তারা আমাদের আড্ডায় যোগ দিলেন। আড্ডা শেষে পার্ক ইন এ আসলাম। কিছুক্ষণ টিভি দেখে ঘুম।
মজনু সাহেব রাতে টেলিফোন করে ছিলেন। গোসল শেষ করেছি। টকটক শুনে দরজা খুললাম। মজনু সাহেব দুহাতে দুটো কাগজের ব্যাগ নিয়ে দরজায় ঢুকলেন। সকালের খাবার নিয়ে এসেছেন। তার অনুরোধে খেতে হলো। নাস্তা খেলাম না। পরে কলা, কফি খেয়ে লবিতে আসলাম। মন্ত্রী মহোদয়, নজরুল লবিতে বসে আছেন। সাড়ে নয়টায় রহিম সাহেব এসে দাড়ালেন। কনফারেন্স এর জন্য রওনা দিলাম। কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিন শুরু হয়েছে। সদস্য দেশগুলো কান্ট্রি পেপার উপস্থাপন করছে। আজ বাংলাদেশ ডেলিগেট এর পক্ষে মন্ত্রী মহোদয় কান্ট্রি পেপার উপস্থাপন করবেন। ১২ নম্বর সিরিয়ালে বাংলাদেশের সুযোগ আসবে। আমরা বাংলাদেশ ডেলিগেটের সবাই ১২ নম্বর সিরিয়ালের জন্য অপেক্ষা করছি। মন্ত্রী মহোদয় ডায়াসে যাওয়ার আগে বললেন;
‘‘আমি তো ইংরেজীতে বক্তৃতা দিবো, আপনারা আরবীতে শুনবেন। সোয়াব হবে।’’
জোকটা সবাই খুব উপভোগ করলাম। ফিরে আসার পর বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের মাহবুব বললেন;
‘‘আপনার বক্তৃতা আরবীতে কিছুক্ষণ শুনেছি, স্যার।’’
মাননীয় মন্ত্রী মহোদয় কৌতুক করে বললেন।
‘‘সাবাস, অনেক সোয়াব পাবেন।’’
মাহবুব সাহেব বললেন;
‘‘একজন মহিলা আরবী অনুবাদ করছিলেন।’’ শুনে জোক করে বললাম।
‘‘সোয়াব অর্ধেক হয়ে গেছে।’’
পরিবেশ বেশ হালকা হয়ে গেছে। আরও ২টি দেশের বক্তব্য দিয়ে প্রথম সেসন শেষ হলো। দুপুরের খাবারের জন্য ক্যান্টিনে গেলাম। পালংশাক, কপি, বরবটি দিয়ে ভাত খেয়ে আড্ডা দিচ্ছি। বিকাল ৩-০০ টায় কনফারেন্স শুরু হবে।
৩-০০ টায় কনফারেন্স শুরু হলো। ৩১টি দেশ বক্তব্য বাখবে, চলবে রাত ১০-০০ টা পর্যন্ত। অন্য দিকে কমিটি অব দি হোলে ডিবেট এর কাজ চলবে রাত ১২-০০টা পর্যন্ত।
৪-০০ টায় আইএইএ এর পরিচালকের সংগে সাক্ষাৎ ছিল। আমি, মস্কো বাংলাদেশ দূত, চেয়ারম্যান বাংলাদেশ আনবিক শক্তি কমিশন, সংগে ডেলিগেটের দলবল নিয়ে তার সংগে কথা হলো। তাঁকে নভেম্বরে বাংলাদেশে আর্ন্তজাতিক সেমিনারে আমন্ত্রণ জানালাম। শহীদ সাহেব আসলেন। এক সংগে কফি খেলাম। ৬-০০ টায় কমিটি হলে নজরুলকে কনফারেন্সে বাংলাদেশের পতাকা পাহারার ৪ জনকে দায়িত্ব দিয়ে বিদায় নিলাম।
রহিম সাহেব ফিরোজ তাঁদের চুলা চালু রেখেছেন। ট্যাংগরা মাছ, শব্জি, ডাল রান্না হয়েছে। ভাত খেয়ে শহীদ ভাইকে নিয়ে রুমে আসলাম। আড্ডা মেরে তিনি বিদায় নিলেন। ঘুম দিলাম। নাস্তা খেয়ে অপেক্ষা করছি। রহিম সাহেব আসলেন। মন্ত্রী সাহেব ও আমি তাঁর গাড়ীতে রওনা দিলাম। ৩য় দিন কনফারেন্স চলছে। প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখছেন। কেউ শুনছে না, তবে তালি দিতে কেউ কারপণ্য করছেন না। হঠাৎ একটা ভাবনা মনের কোনে উকি দিল।
‘‘কেউ শুনছে না। তা হলে তালি দিচ্ছে কেন?’’
অশরীরী আত্মার জবাব,
-‘‘শুনছে না তাই তালি দিচ্ছে। কমপেনসেট করছে। শুনলে হয়তো তালি দিতে পারতো না।’’
মনে মনে হাসলাম। শুনছি, তালি দিচ্ছি, সময় চলে যাচ্ছে। কোন কোন প্রেজেনটেশন নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাচ্ছে। তালি দিচ্ছি দেখে, দিলীপ জানতে চাইল,
-‘‘তালি দিচ্ছেন যে!’’ জবাব দিলাম;
‘‘শেষ করেছে তাই তালি দিলাম। না শেষ করলে আমাদেরই কষ্ট হতো।’’
দিলীপ হাসলো।
কান্ট্রি পেপারগুলোর প্রথম অংশ এক ও অভিন্ন। প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন, মহাপরিচালককে তোষামোদ, আইএইএ কি করেছে, আমরা কি করেছি। পরের অংশে অভিযোগ; ইরান, উত্তর কোরিয়া, সিরিয়া আইন মানছে না। অন্যদল বলছে; আমরা আইন মানছি না ঠিক নয়। আমরা মানছি। মানছেনা ইসরাইল, আমেরিকা। তাদের বিষয়ে আইএইএ এর কঠোর অবস্থান নেয়া উচিৎ। বক্তব্য যাই হোক তালির কমতি নাই।
ডিডিজি টেকনিক্যাল কো-অপারেশন এর সংগে আলাপ হলো। মন্ত্রী মহোদয় তার কাছ থেকে সহযোগিতা চাইলেন। তিনি সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আমরা তাঁকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বিদায় নিলাম। শ্রীলংকার ডেলিগেশনের অনুরোধে তাদের সংগে কথা হলো। তারা বাংলাদেশের সহযোগিতা চায়। নিউক্লিয়ার কৃষিতে আমাদের পরামর্শকও নিতে চায়। তাদেরকে মন্ত্রী মহোদয় সব ধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। তারা কি ধরণের সহযোগিতা চান, কোন কোন ক্ষেত্রে, এ সব জানিয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিলাম। সরকারের পক্ষ হতে কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব আমরা নিবো তাও জানালাম। কনফারেন্স রাত ১০-০০ পর্যন্ত চলবে। কমিটি অব হোলে ডিবেট ৬-০০টায় শেষ হয়েছে। ৬-৩০ মিনিটে বিদায় নিলাম। রহিম সাহেবও ফিরোজ বাঁ ধাকপি, চিংড়ি, ভাত, সালাদ করেছে। খেয়ে নিচে নামলাম হোটেল বিলটা পরিশোধ করতে। মেশিনে একটা ৫০ ইউরো নোট নিচ্ছে না। রহিম সাহেব ম্যানেজ করলেন। লবিতে এক কাপ কফি খেয়ে ফিরোজদের বিদায় দিয়ে রুমে ফিরলাম।
কনফারেন্সের শেষ দিন। ফাঁকা হতে চলেছে আইএইএ এর মূল ভেন্যু। সকালে নাস্তা খেয়ে অপেক্ষা করছি কনফারেন্সে যাওয়ার জন্য।
কনফারেন্সে আসা বিচিত্র সব মানুষগুলো বিচিত্র। কেউ ‘এটম মাছি’ উৎছিষ্ট থেকে রস নিচ্ছে। কিছু ‘স্পেন্ট ফুয়েল’ শেষ হয়ে গেছে, ভয়ংকর, এদের ডিসপোজ করতে হবে। কিছু ‘এটম ভিমরুল’ উপকার করবে না, ক্ষতি করার কাজে সদা ব্যস্ত। ‘এটম ব্যবসায়ীরা’ দৌড় ঝাপ করছে কিছু ‘বাখ’ কামায় করার আশায়। সবার উপরে ‘এটম মাফিয়া’ তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে সব কিছু।
আজ বৃহস্পতিবার। সকাল ১১-৪৫ এ উপমহাপরিচালক এর সৌজন্য সাক্ষাৎ। প্লেনারী সেসান এর মাঝে ১১-৪৫ মিনিটে আমরা ২৬ তালায় উপমহাপরিচালক (পারমানবিক শক্তি) এর সাথে দেখা করতে গেলাম। রাশিয়ান ভদ্রলোক আন্তরিক সব পরিচালককে নিয়ে আমাদের সাথে আলাপ করলেন। আলাপ শেষে সবাইকে বাংলাদেশের নক্সিকাথা, চা প্যাকেট দিয়ে বিদায় নিলাম।
মহাপরিচালক আমানো এর সাথে সাক্ষাৎ ছিল ১২-৩০ মিনিটে, হলো না। তিনি সময় পরিবর্তন করে ১৩-৪৫ মিনিটে নতুন সময় নির্ধারণ করলেন। প্লেনারী সেসানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে হলের পাশেই মহাপরিচালকের রুমে গেলাম। ফিরোজকে আগেই ছবি তোলার বন্দোবস্ত করার জন্য পাঠানো হলো। মহাপরিচালক অন্য একদল ডেলিগেটের সাথে আলাপ করছেন। বাহিরে রাখা সোফায় বসতে হলো।
দলটি বাহির হলে আমানো নিজেই এসে সবার সাথে হাত মিলালেন। মুখোমুখি বসে কথা হলো। মন্ত্রী মহোদয় ধন্যবাদ জানালেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার ব্যক্তিগত সহযোগিতা চাইলেন। তিনি হাসিমুখে সহযোগিতার আশ্বাসও দিলেন। তাঁকে বাংলাদেশের নক্সিকাথা আর চাপাতা দিয়ে বিদায় নিলাম। আগেই দুপুরের খাবার ডাল, শাক ও কপি ভাজা খাওয়া শেষ। বিকালে আমরা ব্রাতিশ্লাবা যাবো। প্লেনারী সেসান থেকে বিদায় নিলাম। পথে একটা দোকানে ৩টা ‘এ্যাটম গেঞ্জি’ কিনলাম।
রুমে বসে আছি, ৪ টা বাজলে ব্রাতিস্লাভার পথে রওনা দিবো। ভিয়েনা থেকে স্লোভাকিয়ার রাজধানী ব্রাতিস্লাবা মাত্র ৪০ মিনিটের পথ। ইতালির রাজধানী রোম এর পেটে পুরো দেশ ভাটিকান সিটি। এ ছাড়া কোন দুটো দেশের রাজধানী এত কাছে আছে কিনা, আমার জানা নাই। আগেও ২ বার ভিয়েনায় এসেছি। তখন সংগে ছিল ভিয়েরা লেলভসকা, ছিলো বললে ভুল হবে, তার বাড়ী ব্রাতিস্লাভা, পালারিকভো। তাকে ফেসবুকে খুজেছি স্বশরীরে খুজতাম; সময় করতে পারলাম না। তবুও হাল ছাড়িনি।
রহিম সাহেব চার ঘন্টার জন্য আট সিটের একটা মাইক্রো হোটেল থেকে ভাড়া করেছেন। আমাদের নিয়ে ব্রাতিস্লাভা থেকে ঘুরে আসবে। সকালে কনফারেন্সে যাবো, দুপুরে খাবো, রাতের ভাত রান্না সব জায়গায় সেখানেও রহিম আর ফিরোজ । নিজেকে আমি আগে কখনও এত নির্ভরশীল করে তুলিনি। নির্ভরশীল তাই কৃতজ্ঞতাবোধও অনেক। রহিম সাহেব, বাংলাদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা আপনার কাছে ঋনী, কৃতজ্ঞ।
শুক্রবার, ভাংগা হাট। প্লেনারী সেসন শুরু হবে ১০-০০ টায়। এর আগে ৯-৩০ টায় উপমহাপরিচালক, সেফগার্ড এর সংগে বাংলাদেশ ডেলিগেটের সৌজন্য সাক্ষাৎ। আগে নাস্তা করে রহিম সাহেবের গাড়ীতে ভিয়েনা কনভেনশন সেন্টারে সোজা ডিডিজি এর রুমে। কোন কাগজ পত্র ছিল না। হাই হ্যালো করে তাদের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়ে বিদায় নিলাম। পূর্ববৎ নক্সিকাথা, চায়ের প্যাকেট দিয়ে বিদায়।
প্লেনারী শুরু হয়নি। বিকাল ৩-০০টায় শুরু হবে। পাকিস্তানী ডেলিগেট দেখা করতে চায়। হলের পাশে নিচে তলায় পাকিস্তানী ডেলিগেটের সাথে আলাপ হলো। পরামর্শ দিলেন কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স যেন শক্তিশালী হয়। কাজ আমাদেরকেই বুঝে নিতে হবে। একই সাথে রেগুলাটরি অথরিটি শক্তিশালী হতে হবে। সাক্ষাৎ শেষ, পাকিস্তানী ডেলিগেট দলনেতা মন্ত্রী মহোদয়কে একটি বাক্স গিফট করলেন। কনফারেন্স কাফেটেরিয়ায় শাক, ডাল, ভাত, খেয়ে বিদায় নিয়ে বাজারে গেলাম, কেনাকেটা করলাম। রহিম সাহেব সন্ধ্যায় ভিআইপি বারে নিয়ে গেলেন। তার এক কলিগ অবসরে গেলেন, সৌজন্য পার্র্টি চলছে, পার্টি থেকে তাঁকে বার বার ডাকা হচ্ছে। আমাকে নিয়েই তিনি পার্টিতে গেলেন । কোন ভাষন নাই, কোন কান্না-কাটি নাই, উচ্চ শব্দে গান, কেউ কেউ নাচছে, বারে পানীয় নিয়ে যে যার মত পান করছে্। হাই হ্যালো করে বিদায় নিলাম । ফিরোজের হোটেলে সবজি ভাত খেয়ে বিদায় নিলাম । আগামীকাল ঢাকার পথে যাত্রা । রহিম ফিরোজ টিকেট কনফার্ম, বোর্ডিং পাশ প্রিন্ট করে আমাদের দিলেন । রুমে ফিরলাম।
শনিবার সকাল থেকে ব্যাগ গোছগাছ করছি। মজনু এসে পরাটা, ভাজি সংগে টুকটাক কিছু উপহার দিয়ে গেলেন। তেমন কোন কিছু কেনা কাটা করিনি। তারপরও ব্যাগে জায়গা হচ্ছে না। ব্যাগটাকে সাইজ করে নাস্তা খেতে গেলাম। দিলীপ নাস্তা খাচ্ছে , তার সংগে যোগ দিলাম। পরে জাফর ও কমিশনের মাহবুবও আমাদের সাথে যোগ দিলো। আড্ডা মারতে মারতে নাস্তা শেষ করে ২২২ নম্বর রুমে ফিরলাম। আজ বেলা ১২.০০ টার পর আমি রুমের সব শর্ত হারাবো।
গোছগাছ শেষ, গোসল করে যে কাপড়ে রওনা দিবো পরে নিলাম। সেই রাত ১০-৪০ মিনিটে ফ্লাইট। প্রায় ১২-০০ ঘন্টা ঘুরাঘুরি করে কাটাতে হবে।
জেনেভার রাষ্ট্রদূত গত কালকেই বিদায় নিয়েছেন। আজকে দুপুরের আগে চেয়ারম্যানসহ বাংলাদেশ এটমিক কমিশনের বেশ কয়েকজন বিদায় নিবেন। আমাদের এ সফরটি ভিয়েনা সফর হলেও বিদেশ সফর মনে হয়নি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একজায়গায়, বাংলায় কথা বলা, রাতে রহিম ফিরোজের হোটেলে ডাল ভাত, ফিরে এসে ঘুম।
এটম এর শান্তি বিঘ্নিত করা ব্যবহার নিয়ে বিশ্ববাসীর দূশ্চিন্তা, তা দরকার জন্য বলা। আমরাও চিন্তিত। শান্তির জন্য এটমের ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ জন্যই আমরা এখানে এসেছি।
হোটেল থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ১১-৩০মিনিটে চেক আউট করলাম। ভিয়েনার বাসিন্দা কয়েক জন বাঙ্গালী দেখা করতে এসেছেন। মন্ত্রী মহোদয় সবাইকে চা খাওয়ালেন। গল্প স্বল্প শেষ করে দুপুরের দিকে হাসান ভাইএর বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম।
এয়ারপোর্টের কাছে হাসান ভাই এর বাড়ী। তিনি মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যাচমেট। এ্যাটম এজেন্সি থেকে অবসর নিয়েছেন। এক মেয়ে, এক ছেলে। মেয়ে লেখা পড়া শেষে যুক্তরাজ্যে চাকুরী করে। ছেলে পড়া শুনা করে ভিয়েনায়। হাসান ভাবী গৃহিনী।
সুন্দর দোতলা বাড়ী, সংগে বেইজমেন্ট। সামনে পিছনে বাগান। পাশে লাউ, মরিচ, বেগুন গাছ। বেশ কিছু লাউ, বেগুন, মরিচ এখনও ঝুলছে। এ যেন ছোট একটা বাংলার উঠান। পাশের বাড়ীটাও একজন বাংলাদেশীর, নাম মুজিব। তিনিও পারমানবিক শক্তি কমিশনে কাজ করেন। আরও চারজন বাংলাদেশীর বাড়ী রয়েছে আশে পাশে। সব বাড়ীতে বাংলাদেশী আংগিনা, লাউ, বেগুন, মরিচের ক্ষেত।
বাড়ীতে ঢুকতেই দেখি টেবিলে সিংগাড়া-সমুচা তাকিয়ে আছে। রান্না করতে দেরী হবে তাই হাসান ভাবী নিজের তৈরী সিংগাড়া, সমুচা ভেজে রেখেছেন। সিংগাড়া ভেজিটেবলের, মুখে দিলাম।
‘‘এক কথায় অপূর্ব’’।
ছেলে এসে লাল অরেঞ্জ জুস দিয়ে গেল। পাশের বাড়ী থেকে মুজিব লাউ, ভাত, ডাল নিয়ে এসে আমাদের সাথে যোগ দিলেন। মস্কোর রাষ্ট্রদূত হাসান ভাই এর বাড়ীর কাছেই থাকেন তাঁর ভাই। বাড়ীতে তিনিও হাসান ভাবীর অতিথি। ড. মুজিব, শৈওকত মুজিবের বাড়ী থেকে হাসান ভাবীর বাড়ী। হাসান ভাবী বিশাল পাবতা, ট্যাংড়া, ছোট মাছ, মুরগী, লাউ, চিংড়ি রান্না করেছেন, সংগে আনারসের আচার, পালং শাকও ছিল।
খেয়ে আড্ডা, আড্ডার ফাঁকে অষ্ট্রিয়ার টক ব্লাক ফরেষ্ট, চা, আংগুর মুখে দিচ্ছে। শেষ করার উপায় ছিল না। সাতটা বেজে গেল, বিদায় নিলাম। রহিম সাহেব, মন্ত্রী মহোদয় ও আমাকে নিয়ে আরও দুটি গাড়ীতে করে সবাই এয়ারপোর্ট পৌঁছলাম।
ফিরোজ কাগজ বইপত্র নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে। রহিম সাহেব হাত বাড়ালেন। মালামাল বেল্টে গেছে, বোর্ডিং কার্ডও হাতে এসেছে। এয়ারপোর্টে আসা ভিয়েনা বাসী রহিম, মজিব, মজনু সাহেব এর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। ইমিগ্রেশনে অসম্ভব রকমের বাড়াবাড়ি। বেল্ট, কোট খুলতে হলো। মন্ত্রী মহোদয় সব কিছু খুললেও মেশিনে প্যাপ্যা শব্দ হচ্ছে। পায়ের তলায় মেশিন দিয়ে কি যেন দেখলো।
‘‘প্যান্টের ধাতব হুক, তাই প্যাপ্যা শব্দ হচ্ছে। সিকিউরিটি বুঝতে চাইছেন না।’’
বার বার আর্চওয়ে পার হতে গিয়ে তিনি বিরক্ত হচ্ছিলেন। এক সময় বিরক্ত হয়ে সিকিউরিটিকে বললেন;
‘‘আপনাদের সাথে বাংলাদেশে আমাদেরও একই ব্যবহার করা উচিৎ।’’
মোটামোটি সবাই নাস্তানাবুদ চেক শেষ হল। আমরা বিমানে উঠলাম। আমার সিটের সিট বেল্টে হুক নাই। বলাকাকে বললাম। কোন সিট খালি নাই। পরে বেল্ট না বেঁধেই ভিয়েনা থেকে দুবাই আসলাম। অনেক বিমান একসাথে নেমেছে। বাসে চড়তে হলো। এ গেটে দূতাবাসের কাউকে পেলাম না। পরের গেটে বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তাকে পেলাম। আগের রাতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রটোকল করেছে। তাই মূল প্রটোকল অফিসার আসেনি। সে নতুন, তার উপর তাঁর পাশ দিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায় না। এর ওর কাছ থেকে জেনে নিয়ে আমরা বিজনেস লাউঞ্জে পৌঁছলাম। নাস্তা চা খেয়ে পাঁচ ঘন্টা পার হতে চায় না। শেষ পর্যন্ত সময় হলো। এমিগ্রেশনের একজন আমাদের গেটে নিয়ে গেলেন। বিমানে উঠলাম। জ্বালানী সচিব আমেরিকা থেকে এসেছেন। একই বিমানে উঠেছেন। তার সংগে কথা হলো। নিজ সিটে গিয়ে বসলাম।
বিমান ছাড়লো, কিছু ক্ষণ শুয়ে, হাটাহাটি করে ছবি দেখে সাড়ে চার ঘন্টা পার করলাম। বিমান ঢাকা হজরত শাহ জালাল বিমান বন্দরে চাকা রাখলো। গেটে প্রটোকল অফিসার, আসাদ, পিএস, মন্ত্রী মহোদয়ের সহকারী একান্ত সচিব-এর সংগে দেখা হলো।
তাঁদের কাছে পাশপোর্ট, লাগেজ দিয়ে ভিআইপি লাউঞ্জে বসলাম। মন্ত্রী মহোদয় কফি খাওয়ালেন। পাশপোর্টের কাজ শেষ। বিশ মিনিটের মাথায় লাগেজও পেয়ে গেলাম। এ্যাটম রাজধানী থেকে বাড়ী ফিরলাম। জয় হোক বিশ্ব শান্তির।
Md. Rafiqul Islam, PhD. | ||