মানিকগঞ্জের ঘিওয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা; মিটিং সেরে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কার্যালয় থেকে ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক দিয়ে বরংগাইল হয়ে ঘিওর উপজেলা কমপ্লেক্সে ফিরছি। রাস্তার পাশে অনেক বুনোগাছ। একটা গাছে লাউ লতা উঠেছে। তলায় বেশ কয়েকটা গোল কচি লাউ। ড্রাইভার সোহরাব গাড়ী থামিয়ে বললো;
-“ একটা লাউ পেড়ে আনি, স্যার।” মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। কার না কার জায়গাজমি। বেচারা কষ্ট করে লাউ লাগিয়ে, ইউএনও এর ড্রাইভার, তাই যা খুশি করবে। বললাম;
-“ আপনার মাথা খারাপ হয়েছে। কার না কার লাউ, আপনি পেড়ে আনবেন?” অদ্ভুত একটা হাঁসি দিয়ে জানালো;
-“ কার না কার লাউ হবে কেন স্যার। খাসজমি মানে আপনার। এ লাউ গাছ কেউ লাগায়নি?”
বলে কি? কেউ লাগায় নি। তা হলে কি এমনি এমনি হয়েছে। মেজাজটা আরও খারাপ করে বললাম;
-“ সোহরাব আপনার মাথা খারাপ হয়েছে। এমনি এমনি লাউ লতা হয়। কেউ লাগিয়েছে। ইউএনও এর অন্যের লাউ পেড়ে খাওয়া লাগবে না। খাওয়ার ইচ্ছে হলে, হাট থেকে কিনে খাবো। গাড়ী স্ট্রাট দেন।”
সোহরাব গাড়ী স্ট্রাট দিলেন। আমরা ঘিওর উপজেলা কমপ্লেক্সের দিকে চলছি। আঁকাবাঁকা গাছপালা ডাকা শরু পথ। গাড়ী জোরে চালানো যায় না। সোহরাব গাড়ী চালাচ্ছে। সে কিছু বলতে চায়। কথাগুলো পেটে ধরে রাখতে পারছে না। এক সময় বলেই ফেললো;
-“ সত্যি স্যার! লতাগুলো কেউ লাগায়নি। এমনি এমনি হয়েছে।”
বিষয়টা জানার ইচ্ছে হলো। জিজ্ঞাসা করলাম;
-“ লাউ এমনি এমনি কেমন করে হয়?” জবাবে জানালো;
-“ কোন সময় কোন ভাবে একটা বীজ পড়েছিল। তা থেকে প্রতিবছর লাউ ধরে। সরকারী জমির লাউ কেউ ধরতে সাহস করে না। দু একটা থেকেই যায়। পরে ঝুনা হয়ে আশে পাশে বীজ পড়ে, লতা হয়, লাউ ধরে।”
সোহরাবের কথায় মনে হলো সে আগেও পেড়ে নিয়ে গেছে। কৌতুহল বসে, জানতে চাইলাম;
-“ আগে কখনও এ ধরনের লাউ পেড়ে নিয়ে গেছেন?”
-“ আগের স্যার মানিকগঞ্জ থেকে আসার পথে লাউ, কুমড়া, আম, জাম, সবকিছুই পাড়তেন। আপনি স্যার কেমন।”
জবাব দিলাম;
-“ ভীতু! সাহস নাই।”
সোহরাব বুঝতে পেরেছে আমি রেগে গেছি। কথা না বাড়িয়ে আপন মনে গাড়ী চালাতে লাগলো। ঘিওর এসে পৌছেছি। গাড়ী থেকে নামলাম। অফিসের দিকে হাঁটছি, দেখে ড্রাইভার বললো;
-“ স্যার ৬.00টা বাজে। অফিসে বসবেন?”
-“ জী হ্যাঁ। ফাইলগুলো দেখে শেষ করবো; তাই অফিসে একটু বসতে হবে।” উত্তর দিলাম।
-“ সালামকে ডাক দিয়ে নিয়ে আসি স্যার। ওরাতো অফিস বন্ধ করে চলে গেছে।”
কোন জবাব না দিয়ে উপজেলা কৃষি বিভাগের নার্সারীটার কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। সোহরাব সালামকে ডাক দিয়ে নিয়ে আসলো। সালাম দরজা খুলে লাইট জ্বালিয়ে চেয়ারটা পরিস্কার করতে চাইলো। বললাম;
-“ দরকার নাই। বাদ দাও।”
কাজ করছি। এমন সময় সালাম জানতে চাইলো;
-“ চা দিবো স্যার?”
-“ দাও।” জবাব দিলাম।
চা এর কাপটা টেবিলে রাখতে রাখতে সালাম বলছে;
-“ মিটিং থেকে ফিরতে ৪:০০টা বেজে গেলে আগে কোন স্যার অফিসে বসতেন না। তাই আমরা অফিস বন্ধ করে দিয়ে চলে গেছিলাম। রাগ করেছেন স্যার?”
-“ না। ” জবাব দিলাম।
আরো বললাম;
-“ আপনাদের আগের স্যার, বউ বাচ্চা নিয়ে থাকতেন। তাঁদের সময় দিতেন। আমার সংগেতো কেউ নাই। একা একা ঘরে বসে কি করবো? অফিসে থাকাই তো ভালো। ফাইলগুলোর সাথে কথা বলা যায়। কাজগুলোও শেষ হয়।”
আমার কথা শুনে অবাক হয়ে জানতে চাইলো;
-“ না স্যার। আগেও কোন স্যার বউ বাচ্চা নিয়ে ঘিওরে থাকতেন না।”
এবার আমি অবাক হলাম। জানতে চাইলাম;
-“ তা হলে ঘরে বসে একা একা কি করতেন?” জবাবে জানালো;
-“ সমাজসেবা, মহিলা বিষয়ক, কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে গল্প করতেন।”
আমি শুনছিলাম, কোন জবাব দিচ্ছি না। দেখে আবারো জানতে চাইলো;
-“ ফাইলগুলোর সাথে কথা বলেন, বললেন। ফাইলগুলো কি করে কথা বলবে? ওদের কি মুখ আছে?”
-“ ফাইলগুলোর মুখ নাই। প্রতিটা ফাইলের সংগে অনেকগুলো মুখের হাঁসিকান্না জড়িয়ে আছে। আমি ঐ মুখগুলোর সাথে কথা বলি।”
সে কোন কথা বলছে না। আমার মনে হলো ও আমাকে পাগল ভাবছে। কথার ফাঁকে ফাঁকে চা শেষ করেছি। খালি কাপটা নিয়ে সে রওনা দিলো।
ফাইলগুলো দেখা শেষ করে একা একা বসে আছি। ভাবছি, এমন আর একটা দেশ পৃথিবীতে আছে কি? কোন কিছু করা লাগে না, লাউ লতা লকলক করে বেড়ে উঠে। চোখ জোড়ানো লাউ লতায় ঝুলে থাকে। ইউএনও সাহেব মিটিং থেকে ফেরার পথে পেড়ে নেন। রান্না করে খান। গল্প করেন। ফাইল গুলো পড়ে থাকে। কারো কোন অসুবিধা হয় না। সময় পার হয়ে যায়।
ভাবছি ফাইলগুলো নিস্পত্তি না করলে কি ক্ষতি হতো। লাভ ক্ষতি কোনটাই খুজে পাচ্ছিলাম না। একবার মনে প্রশ্ন দেখা দিলো;
অনেক মানুষ অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত হতো কি? আবার মনে হলো, ঘোড়ার ডিম হতো। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি।
-“ কে যেন বললো, কিছুই হতো না। এ ভাবেই তো সব চলে।” চলে যাচ্ছে, কিছুই থেমে নাই। আল্লাহ্র দুনিয়ায় কোন কিছুই থেমে থাকে না; চলে যায়। যাওয়ার রকমটা শুধু আলাদা।
পড়াশুনার তাগিদে লম্বা সময় ইউরোপে ছিলাম। গভীরে গিয়ে ভালো করে দেখেছি অনেক জিনিষ। ইউরোপের মাটি কাকরময়। মাঝে মধ্যে বড় পাথর। চাষ দেয়া যায় না। জমি চাষের উপযোগী করে তোলার জন্য বড় বড় পাথর সরানো হচ্ছে। মানুষ গুলোর শরীর দিয়ে ঘাম ঝড়ছে। তাঁদের দেখেছি আর ভেবেছি, বাংলার মানুষ কত সুখে আছে। গরমকাল প্রায় শেষ। তাপমাত্রা শুণ্যের কাছাকাছি। রুমের পানির পাইপের সারি দিয়ে গরম পানির প্রবাহ চালানো হয়েছে। পাইপ থেকে আসা গরম রুমগুলোকে আমার দায়ক করলো। এখন মজা করে ঘুমানো যায়।
রুম, তার মধ্যে পাইপের সারি, গরম পানির প্রবাহ; লেপ, সিমেন্ট এর উপর কাঠের বাতি দিয়ে স্তর দেয়া। বেঁচে থাকার জন্য উষ্ণতা দরকার, উষ্ণতা ধরে রাখার জন্য কত কিছু করতে হয় এদের। আমাদের জীবনটা কত সহজ। আম গাছের নীচে, বাঁশের বাতি দিয়ে তৈরী মাঁচা। মাথার নীচে ভাঁজ করে হাতটা দিয়ে প্রশান্তির ঘুম। এ কথা মনে পড়লো; ভাবছি এরা এসব কোন দিন চিন্তা করতে পারবে?
কয়েক দিন পর সকালে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি। রাস্তা, ঘাট, গাছপালা সব কিছু সাদা। প্যাজা প্যাজা তুলা দিয়ে ঢাকা। পরে জানলাম বরফ পরেছে। জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখলাম। কি বিরুপ প্রকৃতি। এর মধ্যে এরা বেঁচে আছে, ভালো আছে। বিরুপ জীবনাটাকে উপভোগ করছে। আমরা ধুকছি কেন?
লেপগুলো ভারী নয়, হালকা, তবে গরম। কৌতুহল বসত একটা ছিদ্র করে তুলা দেখলাম। না, এগুলো তুলা নয়। অন্য কিছু। আমার পাশের রুমে থাকে “কনস্তানতিন” তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম;
-“ লেপগুলো কি দিয়ে তৈরী?” জবাবে জানালো;
-“ পেরিনা-পাখির পালক। বিশেষ যন্ত্র দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করে তা দিয়ে এগুলো তৈরী করা হয়।”
-“ তোমাদের দেশে পেরিনা নাই?” সে জানতে চাইলো;
-“ আমাদের এসবের প্রয়োজন হয় না। ঠান্ডা নাই।”
-“ কি মজা। তোমাদের কোন কষ্ট করতে হয় না। তোমরা পাখির পালক গুলো দিয়ে কি করো?” সে জানতে চাইলো;
-“ কিছুই করি না। ফেলে দেই।” সে অবাক হলো।
-“ তোমাদের রুমে গরম পানির প্রবাহ লাগে না?” তাঁর জিজ্ঞাসায় দুষ্টামি করে জবাব দিলাম;
-“ আমাদের রুমেরই দরকার হয় না। গরম পানির প্রবাহ এ দিয়ে আমরা কি করবো?” শুনে অবাক হলো। বললো;
-“ বড় ভালো দেশ। অভিজ্ঞতার কোন দরকার নাই। অভিজ্ঞতা গুলোকে তোমাদের পরবর্তি প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে হয় না। অথচ এজন্য আমাদের কি কষ্ট ই না করতে হয়।” তাঁর কথাগুলো আমার বোধগম্য হলো না। বললাম;
-“ কিছুই বুঝলাম না।”
-“ কিভাবে বাড়ী বানাতে হবে? কিভাবে পানির পাইপ সেট করতে হবে? কখন পানি গরম করার জন্য কাঠ বা কেরসিন সংগ্রহ করে রাখতে হবে? কবে পানি গরম করে প্রবাহ শুরু করতে হবে সব কিছু আমাদের পূর্ব পুরুষ নক্সা করে, লিখে দলিল আকারে না রেখে গেলে আমরা বেঁচে থাকতাম? তুমিও আমাদের দেশে লেখাপড়া করতে আসতে কি?”
তাঁর প্রশ্নগুলো আমাকে রিখটারের সর্বোচ্চ দশ মাত্রার ভূমিকম্পের মত নাড়া দিলো। আমি ভাবছি, বিরুপ প্রকৃতি তাঁকে অভিজ্ঞ করেছে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তাঁরা অভিজ্ঞতার দলিল তৈরী করে রেখে যাচ্ছে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য কোন কিছুর প্রয়োজন হয়নি।
ঘিওরের রাস্তায় এমনি এমনি লাউ হয়। পুকুর কোন কিছু ছাড়াই কই, শিং, মাগুরে ভর্তি। আমার জানার প্রয়োজন হয়নি;
-“ কিভাবে লাউ বীজ সংরক্ষণ করতে হয়?”
-“ কিভাবে লাউ লাগাতে হয়?”
-“ মাছের পোনা কিভাবে তৈরী করতে হয়? মাছ চাষের জন্য কি করতে হবে?”
এ লোকগুলো এসব না জানলে, না খেতে পেয়ে মারা যাবে। প্রয়োজন ছিল না, আমরা কাজগুলো করিনি। করলে আমাকে এখানে এদের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে আসতে হতো না। এখান থেকে এদের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার দেশের কি কাজ হবে আল্লাহই জানেন। এসব ছাইপাশ ভাবছি। হঠাৎ একটা গল্প মনে পড়ে গেল। রুমের গরম যাতে বেরিয়ে না যায়, এজন্য স্কটিশরা কুকুর, বিড়ালের লেজ কেটে দেয়। তাঁদের অভিজ্ঞতা নিয়ে এসে বাংলাদেশও আমরা কুকুর, বিড়ালের লেজ কাটছি। কেন জানি না।
বুলগেরিয়ার রাজধানী সোফিয়া এবং কৃষ্ণ সাগরের তীরের ভার্ণা শহরে প্রায় ২ বছর কেটে গেছে। গ্রামে যাওয়া, থাকা, দেখা কোনটাই হয়ে উঠে নি। গরমে ৩ মাস ছুটি। বুলগেরিয়ান ছাত্র ছাত্রীদের হোষ্টেল ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যেতে হয়। শুধু আমরা কয়েকজন বিদেশী হোষ্টেলে থাকি। গরমের ছুটির আগে আমার সহপাঠি ‘পেতার’ জানতে চাইলো;
-“ ছুটিতে কি করবা?” কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা ছিলো না। জবাব দিলাম;
-“ ভার্ণাতে থাকবো। সুযোগ হলে দোভাষীর কাজ করে কিছু কামায় করবো। বাকি সময় পর্যাটক, সমুদ্র নিয়ে মজা করবো।” শুনে প্রস্তাব দিলো;
-“ আমার সংগে আমাদের গ্রামের বাড়ি চলো। অনেক মজা করতে পারবে।”
প্রস্তাবটা মন্দ নয়। বুলগেরিয়ার গ্রাম দেখা, গ্রামে থাকার ইচ্ছা ছিল অদম্য। রাজি হয়ে গেলাম। বুলিগেরিয়ানরা ছুটির পর একদিনও হোষ্টেলে থাকতে পারে না। তাঁদের রুম গুলো হোষ্টেলে রুপান্তর করে বিদেশীদের ভাড়া দেয়া হয়। আশি লক্ষ লোকের দেশ বুলগেরিয়া, বছরে পর্যাটক আসে প্রায় এক কোটি। ছুটির আগের দিন আমরা হোষ্টেল ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ি ‘রুসে’ এর দিকে যাত্রা শুরু করলাম। ভার্ণা থেকে ‘রুসে’ প্রায় 300 কিলোমিটার। ট্রেন যোগাযোগ ভালো, বেশী সময় লাগলো না। দুপুরের আগেই পৌছে গেলাম। পেতারের বাবার খামারের পিক-আপ ভ্যান আমাদেরকে রেলষ্টেশন হতে তাঁদের বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এলো।
পিকাপে উঠে হঠাৎ মাথায় ডুকলো, পেতারের সংগে তাঁদের গ্রামের বাড়ি আসা ঠিক হলো কি? পেতারের মা, বাবা, দাদী, বোন এরা কি ভাবে নিবে? এসব কিছু ভাবতে ভাবতে সিদ্ধান্তের জন্য নিজেকে বারবার ধিক্কার দিচ্ছি;
আগপাছ চিন্তা ভাবনা না করে এ সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক হয় নি। ‘পেতার’ কনুই এর একটা গুতো দিয়ে বুলগেরিয়ান ভাষায় জানতে চাইলো;
-“ ‘ইস্ত তিবিয়া’- তোর কি হলো?”
নিজেকে সামলে নিয়ে জবাব দিলাম;
-“ না কিছু না?”
-“ তোমার গ্রামের তোমার মায়ের কথা মনে পড়েছে? তাই মন খারাপ?” তাঁর জিজ্ঞাসার কপট জবাব দিলাম;
-“ হ্যাঁ।” জবাব শুনে সে দুঃখ প্রকাশ করলো।
আমরা পেতারদের বাড়ীর আংগিনায় পৌছে গেছি। পেতারের ছোট বোন ‘সেভেতলানা’ দশম গ্রেডে পড়ে। দৌড়ে বাহিরে এসেছে। ‘পেতার’ নেমে তাঁকে জড়িয়ে ধরে চুমুই চুমুই ভরিয়ে দিচ্ছে। শেষে তাঁকে জড়িয়ে ধরে একটা চক্কর দিলো। মনে হচ্ছে দু’টো রাজ হাঁসের ব্যালে নাচ। মুগ্ধ হয়ে চেয়েছিলাম। সেভেতলানা তার ভাই এর কাছে জানতে চাইলো;
-“ আমার জন্য কি এনেছো, তাড়াতাড়ি দাও।”
-“ আমি কিছু আনিনি। এসেছে আমার বন্ধু, বাংলাদেশী, রফিক।” সেভেতনামা আমার দিকে এগিয়ে এসে
‘ইজদ্রাবেই’-স্বাগতম” বলে একটা চুমু দিলো।
আমি তাঁর জন্য একটা গোলাপী জামা এনেদিলাম। তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বললাম;
-“ ‘পেতার” যে মাপ বলেছে, সে মাপেই এনেছি। না লাগলে, পরিবর্তন করা যাবে।”
খুশিতে নাচতে নাচতে সে ভিতরে ঢুকলো। আমরাও ভিতরে ঢুকলাম। পেতার এর মা বাড়ীতেই ছিল। তাঁর সংগে পরিচয় হলো। ইতোস্তত করছিলাম। সংশয় ছিলো তাঁরা কিভাবে নিবেন। পরিচয় পর্ব শেষ করে বললাম;
-“গ্রাম দেখার শখ ছিলো। পেতার বললো, চলে এসে আপনাদের বিব্রত করলাম।”
কথা গুলো শুনে পেতার এর মা ‘ভ্লাদিমোভা’ কষ্ট পেলেন বলে মনে হলো। বললেন;
-“ তুমি আমার ছেলের বন্ধু। আমার ছেলের মত। বিব্রত হবো কেন বাবা।”
মায়ের কথায় লজ্জা পেলাম। রাতে হইচই, গান বাজনা, নাচানাচি সংগে বুলগেরিয়ান বিশেষ পানীয় ‘‘রাকিয়া’’। বেশ জমে উঠলো; খুব উপভোগ করলাম।
পেতার এর বাবা, দাদী বড় মজার মানুষ। কালো কোন মানুষের মুখে প্রথম বুলগেরিয়ান ভাষায় কথা শুনছেন। কোন উচ্চারণে মজা পেলেই আবার বলতে বলছেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে পেতার জানালো;
-“ কাল ভুট্টার বীজ ছাড়ানো হবে। দেখতে যাবো।” অনাপত্তি জ্ঞাপন করে বিদায় নিলাম। সেভেতলানা অতিথি কক্ষে আমার শুবার ব্যবস্থা করেছে।
পরের দিন সকাল বেলা মুখ হাত ধুয়ে নাস্তা খেয়ে ভুট্টার বীজ খুলা দেখতে গেলাম। বাতাস ডুকবে না, এমন একটা পাত্রে বীজ রাখা হয়েছে। পাত্রটি খোলা হলো। ভুট্টার মোচাগুলো আস্ত। সবগুলো একই সাইজের। অবাক হয়ে বললাম;
-“ ভুট্টার বীজ এভাবে রেখেছেন কেন?” জবাব শুনে অবাক হলাম। জনালো;
-“ বাহিরে ঠান্ডায় রাখলে বীজগুলো হতে গাছ হতো না। তাই এ ভাবে রাখা।” পেতার আরও জানালো;
-“ বীজ কিভাবে রাখতে হবে তা রেকর্ড করা আছে। ছোট বেলায় এটা হাতে কলমে আমাকে শিখানো হয়েছে।”
-“ সব মোচা গুলোর সাইজ এক রকম। প্রতিটা গাছেই একই সাইজের মোচা হয়?” জানতে চাইলাম। জবাবে পেতারের বাবা জানালো;
-“ না বাবা। ক্ষেত থেকে বেছে বেছে এই মোচা গুলো সংগ্রহ করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বীজ করবো বলে। ভাল বীজ না হলে ফসল ভালো হবে না।”
পেতারের বাবার কথা গুলো আমাকে ছোট বেলায় নিয়ে গেল। মা বলছেন;
-“ হেরাস! বিছনের ল্যাগ্যা কিছু ধান আলাদা কইর্যা র্যাখ্যা দিও।”
জবাবে হেরাস ভাই জানালো;
-“ আলাদা কইর্যা রাখার কি দরকার! চাইল করার পর যা থাকবে তাই বিছন হিসাবে বুনলেই হবে।”
মা মহিলা মানুষ, চাষবাস কম বোঝেন। কথা বাড়ালেন না। প্রতি বছর কিছু বাড়তি ধান থেকে যায়। পেতারের বাবার মত আলাদা কোন শ্রম দিতে হয় না। ভালো বীজ, চাষ, সেচ না দিলে ফলন ভালো হবে না। জমি কম, ফলন ভালো না হলে মরতে হবে। ইউরোপ ভালো ফলন পাওয়ার জন্য কিভাবে ভালো বীজ বাছাই করতে হবে, কিভাবে তা সংরক্ষণ করতে হবে, সব কিছু লিখে রেখেছে। তা না হলে এদের অস্তিত্ব থাকতো না।
একবার নতুন ভাইরাস আয়ারল্যান্ডের আলু ক্ষেতে আক্রমন করলো। এ ধরনের ভাইরাসের আক্রমন মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা তাঁদের জানা ছিলো না। আলু গাছগুলো পঁচে সার হয়ে গেল। সেবার কোন আলু হয়নি। মানুষ না খেয়ে মরেছে। মরনের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাঁরা জাহাজে করে আমেরিকা পাড়ি দিয়ে দেশান্তরী হয়েছে।
আয়ারল্যান্ডের ইয়র্ক এর বাসিন্দা দেশান্তরী হয়ে আমেরিকায় গড়ে তুলেছে নিউইয়র্ক, নিউসাউথ হিয়ামটন, নিউক্যালেডনিয়া। আমেরিকায় প্রকৃতি এত বিরুপ নয়। তাঁদের অভিজ্ঞতা দিয়ে অল্প সময়ে তাঁরা আমেরিকাকে পরাশক্তি বানালো। মনের কোনে একটা প্রশ্ন উকি দেয়;
-“ আচ্চা আমরা কি করছি?”
বাংলাদেশ আজ আগেরমত নাই। ঘরে ঘরে চাল বাড়ন্ত। বেশী চাল উৎপাদন করতে হবে।এত কিছুর পরও আমাদের কোন কিছুই করতে হলো না। আমেরিকা হতে এলো হাই ইয়েলডিং ভ্যারাইটি। আগে বিঘায় পেতাম ৭-৮ মণ ধান; এখন পাই 25-30 মণ। কোন চিন্তা নাই। সার আর সেচটায় কিছু বেশী খরচ লাগে। এ ভাবনাটাও চীনারা কমিয়ে দিয়েছে; কম দামী সেচ মেশিন তৈরী করে।
আমরা এখনও আগের মতই আছি। বস্তিবাসি, তাতে কি চিন্তাহীন, অভিজ্ঞতাহীন দলিল বিহীন একটা জাত। প্রকৃতি আমাদের অকাতরে সব কিছু দিয়েছে, করেছে অলস।
Md. Rafiqul Islam, PhD. | ||