আমার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
লালমাটির মানুষ। ইলামিত্রের বিদ্রোহের আগুন দগদগ করে জ্বলে আমার বুকে; ল্যাংড়া, ফজলীর রসালো স্বাদ লেগে থাকে আমার মুখে; সুযোগ পেলেই ছুটে আসি ‘আমি আমারি মাঝে’।
বাবার হাত ধরে রাজশাহী ঘুরছি। বাবা বলছেন;
এটা রাজশাহী কলেজ, এটা মিউনিসিপ্যালিটি, ওটা মেডিক্যাল কলেজ, ওটা ইঞ্জিনিয়ারিং, এটা হলো রাজশাহী ইউনিভারসিটি।
বাবা টমটমওয়ালাকে বললেন, টমটম ঘোরাও। জিজ্ঞাসা করলাম,
-“রাজশাহীতে আর কিছু নাই?” বাবা জানালেন,
-আছে, এখান থেকে আর একটু আগে হরিয়ানা সুগার মিল, একটা রেল স্টেশনও আছে। রেলে ফিরবো, তখন দেখতে পাবি।
টিলার খাঁজে খাঁজে জুমচাষের মত থাক থাক ধানের সারি। এটাই ছিল আমার দেখা রাজশাহী, আমার ছোট বেলা
।
তখন কৃষকের মুখে মুখে ঘুরতো ‘খনা’। বাবা খনার একটি চটি সংগ্রহ করে তার কাঠের সিন্দুকে স্বযত্নে রাখতেন। মাঝে মাঝে চটি বইটি বাহির করে পড়তেন।
ইউনুস চাচা, আমাদের জমি আদিতে চাষ করতেন। সন্ধ্যায় বাবার অনুমতি নিতে এসেছেন,
-“তুফানী ভাই। দুই হাল দিয়্যাছি। মাটি খুব ভালো। ক্যাল বিছন ছিটিয়া দি?”
বাবা কোন জবাব না দিয়ে দৌড় দিয়ে ঘর থেকে ‘খনা’কে বের করে আনলেন। পড়ছেন;
“ষোল চাষে তুলা, তার অর্ধেকে মুলা,
তার অর্ধেক এ ধান, বিনা চাষে পান।”
বাবার চেহারা পালটাচ্ছে। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন;
“ইউনুস কি বুললি, দু’হাল দিয়া ধান বুনবি?” ইউনুস চাচা হতবাক হয়ে তাঁর অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন,
-“বুনলে কি হবে? মাটি তো ভালো আছে।” বাবা আরও ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন;
-“ তোর কথা আমি শুনবোনা; খনা যা বলেছে তাই কর।”
ইউনুস চাচা কোন কথা না বলে চলে গেলেন। আরও কয়েকদিন পর আরও দু’হাল দিয়ে বিছন ছিটানো হলো। ধান কাটার সময় ইউনুস চাচা বললেন;
-“তুফানী ভাই, ভুঁই এ এইব্যার ধান ভালো হয়েছে।”
বাবা কোন জবাব না দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
অনেক দিন বৃষ্টি নাই। রাস্তায় হাটু ধুলা, মাঘ পার হয়ে ফাগুনের মাঝা-মাঝি, বাবা সন্ধ্যায় ইজি চেয়ার নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকেন। চাঁদের চারদিক ঘিরে বলয় তৈরী হয়। বাবা নিজে নিজে বলতে থাকেন,
-“হবে, হবে।”
কি হবে বুঝতে পারি না, বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে ভয় পাই। বাবার পাগলামী দেখে একদিন জিজ্ঞাসা করেই বসলাম,
-“তোমার কি হয়েছে? এমন পাগলামো করছেন কেন?”
জবাবে বাবা বললেন:
খনা বলেছে;
“যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পূণ্যি দেশ।”
আরো বলেছেন,
“যদি বর্ষে ফাগুনে
রাজা যায় মাগনে।”
এখন ফাগুনের শেষ; এখন বৃষ্টি হলে রাজা যাবে মাগনে, তা হলে আমাদের কি হবে?”
কিছুই বুঝলাম না, চুপ করে রইলাম। বুঝলাম মংগা শব্দটি কোথা থেকে এসেছে।
বাবা বলছেন;
“যদি ফাগুনেও বৃষ্টি না হয় তা হলে কি হবে,
খনা তো কিছু বলে যায় নি। আমরা কি করব?”
প্রকৃতির অসহায় কিট হিসাবে বাবাকে দেখে আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করেছিল,
-“আমাদের একটা খনা দাও। একটা খনা দরকার”। তখন বুঝিনি খনা আর কেউ না, খনা বিজ্ঞানী, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তাঁকে লালন করেনি, তাঁকে সবকিছু বলে যাওয়ারও সুযোগ দেয়নি। আমরা তাকে খুন করেছি।
বাবার দূর্বলতাটা আমাকেও পেয়ে বসেছিল। সুযোগ পেলেই চুরি করে বাবার খনার চটিটি পড়তাম। একটা ছড়া আজও মনে আছে:
“কলা রুয়ে না কেটো পাত
তাতেই কাপড় তাতেই ভাত।”
অনেক দিন মনে ছিল না খনাকে। পেয়ে বসেছিল নিহারঞ্জন, কুয়াশা, মাসুদ রানা এ সব। যখন মনে পড়লো খনাকে, বাবা বিদায় নিয়েছে। খনাকে খুজলাম। পেলাম না কোথায়। অভিমান করে চলে গেছে।
আগের পড়া শ্লোকগুলো মনে করার চেষ্টা করলাম,
আবছা আবছা মনে পড়লো:
“মাঘের আট ফাগুনে আট
ফুটলে ফুটলো না ফুটলে শুকান কাঠ।”
৮ ফাল্গুন আম গাছে মুকুল না দেখলে আত্মা শুকিয়ে যেতো। প্রিয় পাঠক শ্লোকগুলো স্মৃতি থেকে বলছি। ভুল হলে ক্ষমা করে দিবেন।
প্রকৃতির রুপ-রস-গন্ধ ছেড়ে রাজনীতি নিয়ে মেতে উঠলাম। মনে মনে শপথ নিলাম, রাজনীতি দিয়ে সব কিছু পালটিয়ে দিবো।
বুকে সুকান্ত, মুখে নজরুল;
‘রানার, রানার, এ বোঝা টানার দিন শেষ হবে কবে
আবার নতুন সূর্য্য উঠবে কবে।’
রাজনীতি পালটিয়ে রানারকে বাঁচাতে হবে। ভাবনার সাথে বড় ভাইদের গর্জন।
বিপ্লবী বড় ভাইয়েরা বলছেন, এভাবে হবে না। রাজা বদলাতে হবে। বড় ভাইদের সুর ধরে স্লোগান দিতে শুরু করলাম।
‘লাথি মার ভাংগরে তালা
জ্বালা সব বন্দি শালায় আগুন জ্বালা আগুন জ্বালা।’
বাংগালী লাথি মারছে, একের পর এক তালা ভাংছে। আংরেজ সাহেবদের বন্দিশালা ছাই হয়ে গেলো। আমরা রয়ে গেলাম তিমিরেই। আমাদের অজ্ঞাতে তৈরী হয়েছে পাকিস্তানী বন্দিশালা। পাকিস্তান সৃষ্টির দিন ১৯৪৭ সাল থেকেই শুরু হলো লাথি মারা। গর্জে উঠলো বাংলাদেশ। আঘাতে, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল পাকিস্তানী বন্দিশালা। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ, আকাশ-চুম্বি প্রত্যাশা, পূরণের পথ নাই। আমরা অপেক্ষা করতে পারলাম না। শুরু হলো লাথি মারা। বঙ্গবন্ধু ঘাতকদল তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করলো। তিনি রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে সত্যটা উম্মোচন করে গেলেন:
“তোমরা যদি তোমাদের কাজ না কর, আমি তোমাদের কিছুই দেবার পারুম না।”
বুঝলাম, শাসন ব্যবস্থা সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারে। নিজেরটা নিজেদেরকেই করতে হবে।
কষ্টটা পাথরের মত বুকে চাপা রইল। মানুষগুলো আগের মতই রয়ে গেছে। তাঁরা মনে করছেন সরকার তাদের সব কিছু করে দিবে। সবার মুখে একটাই কথা:
-“কি পেলাম?”
-“আমার কম্বল কোথায়?”
-“আমরা কি খাবো?”
মানুষ মনে করেছে সরকারের কাছে সব কিছু আছে, তাঁরা তা আঁকড়ে ধরে আছে। গুটি কয়েক মানুষ লুটে পুটে খাচ্ছে। তাঁরা শ্রেণীর শত্রু, তাঁদের সব কিছু কেড়ে নিতে হবে, সরকারকে হটাতে হবে, শ্রেণী শত্রু খতম করতে হবে। এরা সব কিছু সরকার দিয়ে পালটাতে চান। খেটে খাওয়া মানুষ রাজনীতি বুঝে না। ডাল ভাতের আশায় খনা বেশী করে আকড়ে ধরলো।
কেউ খনার বাহিরে আসতে পারলো না। ফাগুনে বর্ষণ হলে রাজা কেন যাবে মাগনে? এর কি কোন বিকল্প নাই? এর জন্য কি করা দরকার। ফাগুনে বর্ষণ হলে আমের মুকুল পুড়ে যাবে, আম চাষীর মাথায় বাজ পড়বে কেন? আমরা কি সারা বছর আম ফলাতে পারি না? বিজ্ঞানীরা তা করতে পারেন, করেন নি।
আমাদের অনেক পরে ভিয়েতনাম স্বাধীন হয়েছে। নভেম্বর মাসে ঢাকার বাজারে আম দেখে অবাক হলাম। বাক্সগুলো দেখে অবাক হলাম, ভিয়েতনাম থেকে আমদানী করা। ভিয়েতনামের আমগাছে সারা বছর আম ধরে। খনাকে কাঁচকলা দেখিয়ে তারা বলছে,
এক পথ বন্ধ হলে দশপথ খুলে যায়। শুধু পথগুলো খুজে নিতে হবে। ভিয়েতনাম পথগুলো খুজে পেয়েছে। আমরা পথগুলো খোজার চেষ্টা করিনি। আশির দশকে ‘ব্রাক’ নরসিংদীর মনোহরপুরে শ্যালো-ডিপটিউবওয়েল দিয়ে সেচ দিচ্ছে। খরাকে তারা হার মানিয়েছে, চাষীদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। সেচের কমিশন ব্রাককে নতুন মাত্রায় নিয়ে এলো। মানুষ বলছে:
-‘সরকারকে দিয়ে কিছু হবে না।’
-‘এনজিওরাই মানুষের ভাগ্যের চাকা পরিবর্তন করবে।’
আশির দশক বিদেশী এনজিওর পাশাপাশি ব্যাঙের ছাতার মত দেশী এনজিও গজিয়ে উঠলো। এনজিওর ভিড়ে সরকারের অস্তিত্ব নজরে পড়ে না। বিদেশী সংস্থা দু’হাত খুলে এনজিওদের টাকা দিচ্ছে, শহরগুলোতে এনজিও টাওয়ারগুলো স্বগর্বে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
কাজের সুত্রে ঘিওরের কৃষি কর্মকর্তা আলাপ করতে আসলেন। নামটা আজ আর মনে নাই। তাঁকে বললাম;
-“যেভাবে মানুষ বাড়ছে , আপনারা তাঁদের মুখে খাবার তুলে দিবেন কিভাবে?”
প্রস্তাব রাখলেন,
-“স্যার, পানি, সার, আর বীজ এই তিনটি নিশ্চিত করতে পারলেই উৎপাদন তিনগুন করা যায়।” জিজ্ঞাসা করলাম,
“নিশ্চিত করতে পারলে উৎপাদন তিনগুন হবে। কিন্তু কিভাবে? বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?” কৃষি কর্মকর্তা প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে জবাব দিলেন,
-“স্যার, এটা তো আপনাদের কাজ।”
‘এটা ম্যানেজমেন্টের কাজ জানি। ম্যানেজমেন্ট করবে, হয়তো বা করবে না। না করলে কৃষক নিজেই করে নিবেন। কৃষি বিজ্ঞানী হিসাবে আপনাদেরও তো অনেক কিছু করার আছে। আপনারা না করলে কৃষক কি এটা পারবে?’
কৃষিবিদ হতাশার সুরে বললেন,
“আর কি করবো স্যার। কৃষকদের তো নিয়মিত পরামর্শ দিচ্ছি।” তাঁর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললাম;
-“নতুন একটা কিছু করেন।” আমার কথাশুনে অবাক হয়ে বললেন,
-“কি করতে বলছেন! স্যার।”
“ঘিওরে রাস্তার ধারে শত শত কুল গাছ আছে। এ কুল গাছগুলোকে বাডিং করে উন্নত কুল গাছ তৈরী করেন। ঘিওরের লোকের চেহারা পাল্টে যাবে।” তাঁকে পরামর্শ দিলাম।
কৃষিবিদ নিজ উদ্যোগে ঘিওরে কাজটি করেছেন। পরে ঘিওরের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম। গাছগুলোয় থোকা থোকা বড় বড় কুল দেখে স্বস্তি পেলাম।
লাল মাটির মানুষ, আমার আমের নেশা অনেকটা হিরোইনের নেশার মতই। নিজেকে সামাল দিতে পারি না। ফল ছাড়া একদিন কাটবে আগে ভাবতে পারতাম না। এখন ফল দেখলে ভয় পাই। সব ফলে ফরমালিন। ফল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি। ম্যাজিস্ট্রেট রোকনুদ্দৌলা ফরমালিন মাখানো ফল জব্দ করছেন। ব্যবসায়ীকে জেল খানায় ঢুকাচ্ছেন। টনকে টন ফল মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু ফরমালিন মিশানো বন্ধ হচ্ছে না। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের চেয়ারম্যানকে বললাম:
“স্যার বিজ্ঞানীরা ফরমালিন আবিষ্কার করে পৃথিবীকে অনেক কিছু দিয়েছেন। আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। ফরমালিনের অপব্যবহারে আমরা আজও আতংকিত। আমরা ফল খাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।”
চেয়ারম্যান সাহেব গর্ব ভরে বললেন:
“স্যার শুনে খুশি হবেন। আমাদের বিজ্ঞানীরা ফরমালিন সনাক্তকরণ কিট উদ্ভাবন করেছেন। দামে সস্তা, যে কোন লোক তা ব্যবহার করতে পারবেন।”
অবাক হয়ে বললাম:
“ঐ কিট দিয়ে কি করবো? আরও ফলমূল মাটিতে মিশানো হবে। আরো লোক জেল খাটবে। পুরোদেশ জেলখানা হবে। এটা কি সম্ভব?”
চেয়ারম্যান সাহেব আরো অবাক হয়ে বললেন:
-“স্যার আমরা এত কমদামী একটা কিট তৈরী করলাম। আর আপনি এ ভাবে বলছেন?”
-“বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কারের জন্য ধন্যবাদ। চেয়েছিলাম, চোর যেন চুরি না করে তার পথ খুঁজে বাহির করতে। বিজ্ঞানীরা চোর ধরার যন্ত্র তৈরী করে দিলেন”, জবাব দিলাম।
জবাবে চেয়ারম্যান সাহেব বললেন:
-“স্যার বুঝলাম না।”
“আপনারা বিজ্ঞানীরা আমাদের এমন একটা কিছু দেন যা ফরমালিনের বিকল্প হিসাবে কাজ করবে। দাম ফরমালিনের চেয়ে কম। জনস্বাস্থ্যের কোন ক্ষতি হবে না। দুনিয়া ন্যানো টেকনোলজি নিয়ে ভাবছে। দেখুননা এটা দিয়ে কিছু করা যায় কিনা?” জবাব দিলাম।
চেয়ারম্যান স্যারের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তাঁর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া;
-“বুঝেছি স্যার। বিজ্ঞানীদের বলবো। আমাদের একটা কিছু করতে হবে।”
সুকান্ত শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন করে রানারের দু:খ-কষ্ট লাঘব করতে চেয়েছিলেন। রাশিয়ার সমাজতন্ত্র বিশ্বে নতুন আশার আলো জ্বেলেছিল। রানারের দু:খ লাঘব হয়নি। প্রযুক্তির উন্নয়নে রানারের সে চেহারা আজ আর চোখে পড়ে না। ডাকহরকরার গল্প আজকের প্রজন্মকে তেমন আকর্ষণ করে না। একটি মুঠোফোন ডাকঘরকেই জাদুঘরে পাঠিয়ে দিয়েছে। প্রযুক্তির এই সুনামীকে অনেকে আজও বুকে দিতে পারেনি। তাঁরা বলছেন,
-“এ সব লোক কোথায় যাবে? এদের কি হবে?”
একটি পথ বন্ধ হয়েছে। দশটি নতুন পথ খুলেছে। মানুষগুলোকে নতুন পথ দেখিয়ে দিন। প্রযুক্তি বিমুখ করবেন না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এনে দিবে মুক্তি। আজকে আমাদের দরকার নতুন খনার, আপনারাই আমাদের নতুন খনা।
-----------xx---------------