১৯৯৯ সালে ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট একাডেমীতে ম্যানেজমেন্ট অব একাউন্টিং, অডিট এন্ড বাজেট (ম্যাব) কোর্স সমাপ্ত করলাম। ইংরেজী ভাষার উপর দক্ষতা যাচাই আইইএলটিএস পরীক্ষায় ব্রিটিশ কাউন্সিল হতে ৬.০০ স্কোর প্রাপ্তির পুরস্কার হিসাবে ডিপ্লোমা কোর্সে মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য উত্তর আয়ারল্যান্ডের রাজধানী বেলফাস্ট-এর আলষ্টার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।
আটলান্টিক এর একটি দ্বীপ আয়ারল্যান্ড। দক্ষিণ ভাগ স্বাধীন একটি দেশ। উত্তর ভাগ এখনও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে রয়ে গেছে। গ্যালিভার ট্রাভেলস-এর লেখক জনাথন সুইফট-এর দেশ আয়ারল্যান্ড। জনাথনের গল্প অনুযায়ী ডিম কোনদিক থেকে ভাঙ্গা হবে তা নিয়ে আয়ারল্যান্ডে আদৌ কোন বিবাদ ছিল কি না তা জানিনা। তবে অরেঞ্জ প্যারেড নিয়ে ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্টদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। সভ্যতার দাবীদার আংরেজ জাতি যুদ্ধ বন্ধে ‘ফ্রাই ডে এগ্রিমেন্ট’ করলো।
তারপরও আজও এ যুদ্ধ বন্ধ হয়নি। ইংরেজরা আমাদের হরতাল ভাংচুর নিয়ে অনেক বড় কথা বলে। বড় খারাপ লাগে। মাঝে মাঝে ভাবি এসব বন্ধ করা যায় না। আলস্টারে হারতাল নাই। ভালো লাগে না। হাজার হোক বাংগালীতো, হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও না হলে একঘেয়ে হয়ে উঠে সব কিছু। প্রতিদিন ক্লাস, রাতে এ্যাসাইনমেন্ট লিখতে লিখতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এসব থেকে একটু স্বস্তির আশায় মনে মনে ভাবছিলাম একটা হরতাল হলে মন্দ হতো না। কিন্তু কি আর করা! এখানে হরতাল নেই। অগত্যা প্রতিদিন ক্লাশে যাওয়া। হঠাৎ একদিন একটা নোটিশ এলো, “পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ক্লাশ সাসপেন্ড”। আমি বললাম “দাঁড়া জেনে যাই, কেন?” আমার সহপাঠী বললো, “দরকার নেই। চল যাই। ছুটিতো পাওয়া গেছে”। হোস্টেলে ফিরে এসে টিভি ছেড়ে বসলাম। বেলফাস্টের রাস্তায় বাসে, গাড়ীতে আগুন জ্বলছে। অরেঞ্জ প্যারেড-এর গন্ডগোল। তাই ছুটি। বিদেশের মাটিতে বসে হরতালের স্বাদ পেলাম। ২ দিন ক্লাসে যেতে হয়নি। বড় ভালো লেগেছিল।
মাইক ফ্রেজার আয়ারল্যান্ডের নাগরিক। নিজেকে আইরিশ বলে জাহির করতে ভালবাসেন। তিনি হেলম কর্পোরেশন এর কর্ণধার। হেলম কর্পোরেশন ডিএফআইডি এর অর্থ সাহায্যে বাস্তবায়িত ম্যাব কোর্সটির আয়ারল্যান্ডে ব্যবস্থাপক। মাইক বাংলাদেশের একনিষ্ট ভক্ত। ক’টি বাংলা শব্দ শিখেছেন। প্রায়ই ব্যবহার করেন। যেমন-‘মেগো বাড়ি বরিশাল, মোরা আইনের লোক’। বাঘ তাঁর প্রিয় বিষয়। কেউ বীরত্বপূর্ণ কাজ করলে, তাঁকে বাঘের বাচ্চা বলে ডাকেন। প্রায় ৬ হাজার কর্মকর্তার মধ্য হতে প্রাথমিক বাছাই, ম্যাব কোর্স, তারপর আইইএলটিএস দিয়ে টিকতে পারায় মাইক-এর কাছে আমরা সবাই ছিলাম বাঘের বাচ্চা। আয়ারল্যান্ড যাওয়ার আগে সবাইকে তিনি একটি গেঞ্জি আর ক্যাপ দিলেন। গেঞ্জির পিঠে ও ক্যাপের আগে বাংলার রয়েল বেঙ্গল টাইগার এর ছবি ছিল।
কোর্সের অঙ্গ হিসাবে রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডের প্রখ্যাত ট্রিনিটি কলেজে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো। ৩ রাত্রি সেখানে ছিলাম কলেজ হোস্টেলে। অপূর্ব এক নির্মান শৈলী আর প্রাকৃতির পরিবেশে ট্রিনিটি কলেজ জ্ঞান বিতরণ করছে। কলেজ ছুটি হলেও দর্শনার্থীর ভারে ভরপুর। গরম কাল। স্বল্প বসনারা রৌদ্রে স্নান করছে। জন্ম সূত্রে আদি অকৃত্রিম চকলেট রং এর চামড়া আমাদের, তাই ঢেকে রাখি। বাংলা ছেড়ে আয়ারল্যান্ড গিয়েও কাপড় খুলে মুক্ত হতে পারিনি। বাংলার জাতীয় প্রতীক পিঠে নিয়ে হাঁটছি। বিকিনি পরা তরুণীদের ভিড়ের পাশে লিপা গাছের নীচে বসা এক প্রৌঢ়কে দেখলাম।
-‘হ্যালো; রয়েল বেঙ্গল টাইগার, কাম অন।’ হাত উঁচু করে প্রৌঢ় ডাকছেন।
কার ডাক বুঝতে পারিনি। প্রসংগটাও বুঝে উঠতে না পেরে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি।প্রৌঢ় এর দিকে নজর পড়তেই ‘ইয়েস ইউ; ফ্রম বাংলাদেশ?’ প্রৌঢ় জানতে চাইল, প্রতিটি শব্দ, একটি বাক্য, একটি প্রশ্ন, একটি জিজ্ঞাসা। হ্যাঁ বলার অপেক্ষা রাখেনি। মনে হলো আমরা অনেক দিনের চেনা। সে নাবিক। কয়েক বার চট্টগ্রামে এসেছে। ঢাকাও তাঁর পরিচিত। বাংলা ঝোল তরকারী তাঁর প্রিয় খাবার। সিলেটি ইন্ডিয়ান রেস্তোরার নিয়মিত খদ্দের। কয়েক মিনিট আলাপেই ব্রিটিশদের প্রতি তার ঘৃণা ফুটে উঠলো। তিনি আইরিশদের ব্রিটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা শুনালেন। প্রতিটি বাক্যে ফুটে উঠছিল ব্রিটিশদের প্রতি ঘৃণার প্রতিচ্ছবি। যুদ্ধে হারানো প্রতিটি মূল্যবান প্রাণের প্রতি দরদ। কথার ফাঁকে প্রৌঢ় জানতে চাইলো, ‘বাঘ, তোমাদের জাতীয় প্রতীক কেন?’
-‘বাংলাদেশের সুন্দরবনে এ বাঘের বাস। এ প্রাণীটি আর কোথাও নাই। প্রাণিটি ভয়ংকর হলেও অদ্ভুত সুন্দর। Wild Beauty! বোধ হয় এজন্য! বললাম আমি।
-‘বাঘ তো ঘাড় মটকায়; তোমরা কি কারো ঘাড় মটকিয়েছো?’ প্রৌঢ়ের উক্তি।
- 'না' আমি বললাম।
‘ঘাড় মটকানোর কাজটা করেছে বৃটিশরা। এখন করছে আমেরিকা। তাঁরা নিজেকে বাঘ বলতে পারে। আমরা নিজেদের বড় জোর হরিণ, গরু, মহিষ ভাবতে পারি’ বললো প্রৌঢ় আইরিশ। কথায় কথায় অনেকবেলা গড়িয়ে গেছে। প্রৌঢ় হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, “আমাকে যেতে হবে। প্রৌঢ় বিদায় নিল।
দুপুরের খাবার খেতে হবে। ম্যাকডোনালস-র দোকান খুঁজছি। ভেজিটেবল বার্গার কিনবো। তিন পাউন্ডেই সুন্দর খাবারের আয়োজন। ডাবলিন-এ অনেক ইন্ডিয়ান হোটেল আছে। ভালো ভালো বাংগালী খাবারও রয়েছে। পকেট বারণ করছে। তাই ভেজিটেবল বার্গার খোঁজা।
আইরিশ ভদ্রলোক মনের আড়ালেই বন্ধু হয়ে গেছেন। তিনি চলে গেলেও তাঁর উপস্থিতিটুকু এখনও আমার মাঝে রয়ে গেছে। কেউ কিছু করলে আমরা বলি-‘বাঘের বাচ্চা’। কিন্তু কেন? বাঘের বাচ্চা কি কখনো কোন ভালো কাজ করেছে?
কাউকে গরু বললে রাগ করে। কিন্তু কেন? গরুর মত মানুষের উপকার আর কেউ কি করেছে? জন্মের পর গরুর দুধ, মাখন, মাংস খেয়ে আমরা বেঁচে আছি। গরুর মরার পর চামড়া, গোবর থেকে জ্বালানী, সার কত কিছুই পাচ্ছি। গরু বললে গর্ব করার কথা। অথচ আমরা লজ্জা পাই। পুর্নেন্দ্রপৌত্রীর মত বুক ফুলিয়ে আমাদের বলা উচিৎ ‘গরু ঘাস খায়ে দুধ দেয়’। কি অদ্ভুত বাঘের বাচ্চা বলে আমরা উৎসাহিত করি। গরু-গাধা বলে মানুষকে গাল-মন্দ দিই। অথচ এটাতো হবার কথা নয়। বাংগালী মন কেন এমন!